h-o-r-o-p-p-a-হ-র-প্পা

|প্রাক্-বৈদিক সিন্ধু-যুগ-১০ : সিন্ধু-সভ্যতার পতন|

Posted on: 03/07/2015


16665_449664015096808_2061254681_n

| প্রাক্-বৈদিক সিন্ধু-যুগ-১০ : সিন্ধু-সভ্যতার পতন |
রণদীপম বসু

২.৮ : সিন্ধু-সভ্যতার পতন

পৃথিবীর সকল প্রাচীন সভ্যতার ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, বিভিন্ন কারণে কোন এক অঞ্চলে গড়ে ওঠা সভ্যতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিপুষ্ট হয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের মাধ্যমে গৌরবের চূঁড়ায় উঠে অতঃপর কোন-না-কোন সংকটে পতিত হয়ে আত্মরক্ষার সমস্ত শক্তি হারিয়ে ধ্বংসের কিনারায় পৌঁছে একসময় কালের আয়না থেকে হারিয়ে গিয়ে প্রত্নতত্ত্ব আর ইতিহাসের বিষয়ে পরিণত হয়। হয়তো বা সিন্ধু-সভ্যতার পতনও ঘটেছে এই অবধারিত নিয়মে। কিন্তু প্রয়োজনীয় লিখিত উপাদান ও ঐতিহাসিক দলিলের অভাব থাকায় সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে।


কারো কারো মতে ভূ-পৃষ্ঠ ও জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায় সিন্ধু অঞ্চলের মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তনের ফলে এ অঞ্চলের অনেকাংশে মরুভূমির প্রভাব পড়ায় ধীরে ধীরে মাটি চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এর ফলে এ সভ্যতা আর আগের মতো শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারেনি। মর্টিমার হুইলারের মতে, সভ্যতার শুরুতে প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টিপাত ও বনাঞ্চলের যে চিত্র ছিলো তা শেষ দিকে ছিলো প্রায় অনুপস্থিত। এতে কৃষি-ব্যবস্থার পাশাপাশি বন্দর হিসেবে মহেঞ্জোদারো নগরীর গুরুত্ব হ্রাস পায়। ড. হুইলার মনে করেন সিন্ধু সভ্যতার পতনের বেশ আগে থেকেই এর পতনের আভাস পাওয়া গেছে। পরবর্তীকালের মহেঞ্জোদারো নগরীকে তিনি পূর্বের মহেঞ্জোদারোর ‘ছায়ামাত্র’ বলে অভিহিত করেন।
তাঁর এই মতের উপর নির্ভর করে কেউ কেউ মনে করেন খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ অব্দের মধ্যেই এ সভ্যতার অবক্ষয় শুরু হয়। তার প্রভাবে সিন্ধু-সভ্যতার নগর পরিকল্পনা ও পৌর-ব্যবস্থা ক্রমশ ভেঙে পড়ে। মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা ও অন্যান্য নগরের জনসংখ্যা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়ায় বৃহৎ অট্টালিকার বদলে পুরনো ইটের বাড়ি তৈরি হয়। এমনকি ঘর-বাড়িগুলি রাজপথের উপরে এসে পড়ে এবং একটি বিশৃঙ্খল শহরে পরিণত হয়। কিন্তু সিন্ধু-সভ্যতার পতনে এ যুক্তিটি খুব বেশি গ্রহণযোগ্য হয়নি।

কেউ কেউ মনে করেন সিন্ধু-সভ্যতা ধ্বংসের পেছনে ভূমিকা রেখেছে সিন্ধু নদের ক্রমাগত বন্যা। তাঁদের মতে প্রাকৃতিক কারণে সিন্ধু নদীর জল অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলো। ফলে ক্রমাগত বন্যার আঘাত আছড়ে পড়তো এ সভ্যতায়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা নিশ্চিত যে ২৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে প্রলয়ঙ্করী বন্যায় শহর দুটো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মহেঞ্জোদারো নগরীতে বেশ কয়েকবার বন্যার প্রমাণ পাওয়া যায়। এখানে তিন স্তরে ভয়াবহ বন্যার প্রমাণ রয়েছে। লোথাল ও চানহুদারো শহরও দু’বার বন্যার কারণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে কালিবঙ্গান শহরে বন্যার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবুও শহরটিতে অবক্ষয় দেখা দিয়েছিলো। তাই বন্যা সভ্যতার ধ্বংস করেছে এটি নিশ্চিত হওয়া যায় না। কারণ বন্যা প্রতিরোধ করার অভিজ্ঞতা নিয়েই প্রাচীন সভ্যতার মানুষেরা তাদের সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলো। এক্ষেত্রে কেউ কেউ বন্যার পাশাপাশি প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পকে এ সভ্যতা ধ্বংসের কারণ মনে করেন। যদিও ভূমিকম্প হওয়ায় এ সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিলো এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

সিন্ধু-সভ্যতা ধ্বংস হওয়ার আরেকটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, জীবন জীবিকার প্রয়োজনে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা যেভাবে উদ্ভিদ ও প্রাণী ধ্বংস করেছে একইভাবে তা উৎপাদনে মনোযোগ দেয়নি। ফলে এককালে প্রচণ্ড খাদ্য-সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু এসবই দুর্বল যুক্তির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে বলে মনে করা হয়।
তবে উপরের কারণগুলির কোন একটি বা একাধিকের সমন্বয়ে এ সভ্যতা যদি ধ্বংস হয়ে থাকে তবে তা ঘটেছিলো একেবারে সভ্যতার চূড়ান্তে এসে। তাৎক্ষণিকভাবে এ কারণগুলি প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করার যুক্তি নেই। অর্থাৎ পণ্ডিতদের মতে দীর্ঘদিন ধরে সিন্ধু সভ্যতার পতনের সূত্রপাত হিসেবে সভ্যতার বিভিন্ন অঞ্চলে সূক্ষভাবে অবক্ষয় চলে আসছিলো। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর উপরের স্তর পরীক্ষা করে দেখা গেছে নগর পরিকল্পনা থেকে শুরু করে জীবনের সর্বক্ষেত্রে একটি ভগ্নদশা চলছিলো। মহেঞ্জোদারোর আয়তনও ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসতে থাকে। আগের মতো সুপরিকল্পিত নগর শেষ দিকে দেখা যায়নি। শেষ দিকের মৃৎপাত্র তৈরিতেও অদক্ষতার ছাপ দেখা যায়। ক্রমে জনসংখ্যার চাপ অনেক বেড়ে যাওয়ায় এবং কৃষিক্ষেত্রে তেমন কোন উন্নয়ন না হওয়ায় জীবন নির্বাহে সংকট বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিদেশের সঙ্গে সিন্ধু-সভ্যতার যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো শেষ দিকে তাতেও ভাঙন ধরে। এবং এই সংকট-সঙ্কুল অবস্থাতেই বহিঃআক্রমণের মোকাবেলা করতে হয় সিন্ধুবাসীদের।

অধিকাংশ ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদ বহিরাগতদের দ্বারা সিন্ধু-সভ্যতা ধ্বংসের কারণকে সমর্থন করেন। প্রত্নতত্ত্ববিদ মর্টিমার হুইলার সিদ্ধান্ত করেছেন যে উত্তরদিক থেকে আগমনকারী আর্যদের আঘাতেই ধ্বংস হয়েছিলো সিন্ধু-সভ্যতা। তাঁর এই বক্তব্যের প্রধান ভিত্তি সিন্ধু অঞ্চলে পাওয়া কিন্তু প্রত্ননিদর্শন ও বৈদিক সাহিত্যের বক্তব্য। উৎখননের পর দেখা গেছে আক্রমণকারীদের হাত থেকে সম্পদ রক্ষা করার জন্য সিন্ধুবাসীরা সম্ভবত অলঙ্কার ও মূল্যবান দ্রব্য সামগ্রী মাটির নিচে পুঁতে রেখেছিলো। আবার কোথাও পাওয়া গেছে একসঙ্গে অনেক নরকঙ্কাল। মহেঞ্জোদারোর রাস্তা, সিঁড়ি ও বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু কঙ্কাল পাওয়া গেছে যেগুলির কোন কোনটির মাথার খুলিতে ভারি অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তবে কঙ্কালগুলিতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বিশেষ করে আর্য, অনার্য ও অন্যান্য জাতির লোকের কঙ্কাল প্রাপ্তি থেকে অনেকে মনে করেন সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসীদের একাধিক বহিরাগত শত্রুর মোকাবেলা করতে হয়েছে। বেলুচিস্তান ও ইরানের কয়েকটি উপজাতীয় লোকের সঙ্গে এসব অস্থি ও কঙ্কালের মিল পাওয়া যায়। আবার বেশ কিছু অস্ত্র ও মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে যেগুলো সিন্ধু সভ্যতার মানুষের তৈরি বলে মনে হয়নি। এসব থেকে অনুমান করা হয় প্রাকৃতিক ও আভ্যন্তরীণ সংকটের সঙ্গে বহিরাগত আক্রমণের চূড়ান্ত আঘাত সংযুক্ত হয়েছিলো সিন্ধু সভ্যতার উপর। আর এসবের সম্মিলনেই সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘটেছিলো।

.
আর্য-আক্রমণ ও সিন্ধু-সভ্যতার ধ্বংস :

প্রথমেই স্মর্তব্য যে, সিন্ধু-সভ্যতা ও বৈদিক আর্য-সংস্কৃতির মধ্যে সুস্পষ্ট প্রভেদই হলো সিন্ধু-সভ্যতা মূলতই কৃষি-নির্ভর এবং বৈদিক-সংস্কৃতি মূলতই পশুপালন নির্ভর। ইতিহাসবিদদের কিছু কিছু মতবিরোধ সত্ত্বেও সিন্ধু সভ্যতায় আক্রমণকারী বহিরাগতরা যে আর্য জাতিই ছিলো এই যুক্তির পেছনে প্রত্নতত্ত্বমূলক ও প্রাচীন সাহিত্যমূলক নিদর্শন রয়েছে বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন।

সিন্ধু-সভ্যতা প্রসঙ্গে গর্ডন চাইল্ড বলেন, এর আদি পর্বের চেয়ে অন্তিম পর্বের কথাই আমাদের কাছে স্পষ্টতর। কেননা প্রত্নতত্ত্বে প্রমাণিত হয়েছে, কোনো এক লিপিহীন প্রাক্-সভ্য মানবদলের আক্রমণেই এ-সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিলো।
কিন্তু এই আক্রমণকারী কারা? এ প্রসঙ্গে ১৯২৬ সালেই শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ মন্তব্য করেছিলেন, ঋগ্বেদ থেকেই এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়– বোঝা যায়, যাঁরা বেদ রচনা করেছিলেন তাঁরাই ধ্বংস করেছিলেন সিন্ধু সভ্যতা।

এখানে উল্লেখ্য, ১৯২২ সাল থেকে সিন্ধু-উপত্যকার প্রত্নখননের মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রত্ন-নিদর্শনের উপর ভিত্তি করে যাবতীয় তথ্য-প্রমাণসহ তৎকালীন ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান স্যার জন মার্শাল প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক রিপোর্ট প্রকাশ করেন ১৯৩১ সালে। ঐ রিপোর্টে এবং পরবর্তীকালে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা এ-বিষয়ে শ্রীযুক্ত চন্দ’র মূল মন্তব্যই সুপ্রতিষ্ঠিত সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করতে চেয়েছেন। শ্রীযুক্ত চন্দ এ-বিষয়ে ঋগ্বেদ থেকে কোন্ ধরনের নজির দেখিয়েছিলেন সংক্ষেপে তা উল্লেখ করা যেতে পারে (সূত্র: দেবীপ্রসাদ/ ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৫২-৩)-

‘ঋগ্বেদের অনেক জায়গায় পুরঃ বা পুর্-এর উল্লেখ দেখা যায়।… একটি ঋকে অয়স্-নির্মিত কোনো শতভূজি বা বিরাট পুরের উল্লেখ আছে। অয়স্ মানে লোহা বা তামা।… স্পষ্টই বোঝা যায় মজবুত বা কঠিন অর্থেই এ সব ক্ষেত্রে অয়স্ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।… ঋগ্বেদে কিন্তু আর্য ঋষি ও উপাসকদের বদলে আর্য শত্রুদের সঙ্গেই পুর-এর সম্পর্ক বারবার চোখে পড়ে। ঋগ্বেদের দু’জন বিখ্যাত রাজা– ভরতদের রাজা দিবোদাস এবং পুরু-দের রাজা পুরুকুৎস– পুর-অধিবাসী শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধে নিরত। দিবোদাস ছিলেন… সুবিখ্যাত সুদাস-এর পিতামহ। পরুষ্ণী বা রাবী নদীর পশ্চিম তীরে সুদাস দশটি ট্রাইবকে যুদ্ধে পরাস্ত করেন। ভক্ত দিবোদাসের হয়ে ইন্দ্র ‘অশ্মনময়ী’ শত পুর ধ্বংস করেছিলেন।… আধুনিক বিদ্বানেরা পুর বলতে সাময়িক আশ্রয়স্থল বুঝেছেন।… কিন্তু পুর শব্দের অর্থ হলো নগর বা শহর, কেল্লা নয়। কেল্লার সংস্কৃত প্রতিশব্দ হলো দুর্গ এবং ঋগ্বেদেই তার উল্লেখ পাওয়া যায়।… একটি ঋকে পুর এবং দুর্গ শব্দ পাশাপাশি উল্লিখিত হয়েছে।… ঋগ্বেদের যুগে কোথাও কোনো নগরের চিহ্নই ছিল না– এ-জাতীয় সংস্কার থেকে মুক্ত হলে উক্ত ঋকে শহর এবং কেল্লা উভয়েরই পরিচয় আমাদের চোখে পড়বে। হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারোতে নগরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হবার পর আজ আর এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না যে ঋগ্বেদের আর্যরা বিপক্ষের নগর ও শহরের সঙ্গে পরিচিত ছিল।… এককালে ইন্দ্র-উপাসক আর্যরা সত্যিই এ-দেশের সুসভ্য অধিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, সেই স্থানীয় মানুষেরা নগরে বাস করতো এবং সুরক্ষিত স্থানের আশ্রয় যুদ্ধ করত– এই ঘটনাটি সত্য এবং জনস্মৃতিতে এর স্মৃতি বহুদিন টিকে থেকেছে। তা হলে, আর্যদের ওই শত্রু বলতে কারা? ঋগ্বেদে কি তাদের সম্বন্ধে আর কোনো সংবাদ পাওয়া যায়? আমার মনে হয়, সিন্ধু-উপত্যকায় আর্যরা এই যে স্থানীয় নগরবাসীদের সঙ্গে সংগ্রাম করেছিল, ঋগ্বেদের সমস্ত মণ্ডলেই তাদের নাম দেওয়া হয়েছে পণি।… পণি শব্দটি স্পষ্টই পণ বা মূল্য থেকে এসেছে।… ঋগ্বেদ-উল্লিখিত পণি বলে মানুষেরা ধনী সওদাগর…এবং ঋগ্বেদের নানা জায়গায় এই পণিদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হয়েছে।… ঋগ্বেদের সূক্তগুলি থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, বৈদিক আর্যরা প্রধানত দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল : পুরোহিত ও যোদ্ধা। পশুপালনই তাদের প্রধান জীবিকা, প্রধান ধনসম্পদ বলতে গোরু। কৃষিকাজের প্রচলন ছিল সীমাবদ্ধ।… সিন্ধু-উপত্যকায় সুপ্রাচীন কালে ব্যবসা-বাণিজ্যমূলক জীবন গড়ে উঠছিল। ওই পণিরা খুব সম্ভব ছিল সিন্ধু উপত্যকার প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতার শেষ পর্যায়ের প্রতিনিধি, সেই পর্যায়েই তারা আক্রমণকারী আর্যদের সংস্পর্শে আসে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে সিন্ধু উপত্যকায় যে-ঘটনা ঘটেছিল তার সঙ্গে সমসাময়িক ইজিয়ানের ঘটনার তুলনা করা যায়– উত্তর-পশ্চিম দেশ থেকে একের পর এক আর্য ভাষাভাষীর ঢেউ এসে পড়ে। এই আক্রমণকারীদের মধ্যে ঋগ্বেদে যারা নিজেদের আর্য আখ্যা দিয়েছে তারা উপত্যকার দক্ষিণাংশে নগর ও সৌধবাসী এক সুসভ্য মানবদলের সংস্পর্শে আসে– এরা প্রধানতই ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর নির্ভর করত। বিজেতা আর্যরা ঐহিক সংস্কৃতির দিক থেকে তুলনায় অনুন্নত ছিল; তারা হয় ঐ নগরগুলি ধ্বংস করেছিল আর নয়তো এগুলো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতে দিয়েছিল। ঋগ্বেদের প্রধান দেবতা ইন্দ্রকে বলা হয়েছে পুরোহা বা পুরন্দর– পুর-ধ্বংসকারী। ইজিএন্-এর প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতার মতোই সিন্ধু-উপত্যকার প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতাও আর্য-আক্রমণের আঘাত সহ্য করতে পারেনি।’


পরবর্তীকালে প্রত্নতত্ত্বমূলক আবিষ্কার কীভাবে এ-মন্তব্য সমর্থন করেছে তার কিছু পরিচয় জন মার্শাল, এম এস ভাট, ম্যাকে, মর্টিমার হুইলার, পিগট ও গর্ডন চাইল্ড প্রমুখ প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদদের বক্তব্য থেকে পাওয়া যায়। এ-প্রেক্ষিতে তাঁদের বক্তব্য-বিন্যাসের সহজ সূত্র হিসেবে আমরা দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভারতীয় দর্শন’ গ্রন্থের (পৃষ্ঠা-৫৪-৫) সহায়তা নিতে পারি।
হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারো উভয় ক্ষেত্রেই নগরগুলির বারবার এবং উপর-উপর গড়ে তোলবার পরিচয় পাওয়া যায়– যেন থাকে থাকে সাজানো হয়েছে। কিন্তু দ্রষ্টব্য হলো, নিচের স্তর থেকে উপরের স্তরের দিকে নগরসভ্যতার কোনো ধারাবাহিক উন্নতির ইতিহাস চোখে পড়ে না। উভয় ক্ষেত্রে শুরু থেকেই সু-উন্নত ও সুপরিকল্পিত নগর এবং নগরশাসকদের ব্যবস্থা এমনই নিখুঁত যে কোনো স্তরের কোনো বাড়িই রাস্তাঘাটের উপর এতটুকুও এগিয়ে আসেনি। কিন্তু সর্বোচ্চ– অতএব সর্বশেষ– স্তরটিতে তা নয়। হরপ্পার শেষ স্তরে নগরনির্মাণপরিকল্পনায় অবক্ষয়ের সমস্ত লক্ষণ ফুটে উঠেছে : পুরানো স্তরের ইট ব্যবহার করে নতুন বাড়ি তৈরি হয়েছে, কিন্তু তা অত্যন্ত বাজে ধরনের; অথচ তার নিচে– পুরানো স্তরে– সওদাগরের সুপরিসর চমৎকার বাড়ি। বাড়িগুলোও রাস্তার উপর এগিয়ে এসেছে– হরপ্পা-নগরীর গৌরবের দিনে কর্তৃপক্ষ যেমন নিখুঁতভাবে নগর-পরিকল্পনার আইনকানুন কায়েম রাখতো তা আর টিকছে না। পিগট্ দেখাচ্ছেন, মহেঞ্জোদারোর সর্বোচ্চ পর্যায়টিতেও আতঙ্কপূর্ণ অবস্থা এবং অবক্ষয়ের ছবি সুপরিস্ফুট। আতঙ্কিত নগরবাসী ধনদৌলত গয়নাগাঁটি মাটিতে পুঁতে রাখবার আয়োজন করছে, পথঘাটের উপর বাড়িঘর এগিয়ে আসছে, ইটের গাঁথনি আগের তুলনায় অনেক নিকৃষ্ট, বড় বড় ঘরগুলো ভাগ করে নিয়ে এক বাড়িতে অনেকে একসঙ্গে থাকবার আয়োজন করছে, এমনকি সদর রাস্তার উপরেই মৃৎপাত্র পোড়াবার চুল্লি তৈরি হচ্ছে। এবং এ-নগর আক্রান্ত হবার পরিচয়ও অস্পষ্ট নয়– রাস্তায় সিঁড়িতে মুখ থুবড়ে পড়া মানুষের কঙ্কাল তার সাক্ষ্য। এমনই দুর্দিনে তারা খুন হয়েছিল যখন বাকি মানুষ প্রাণ নিয়ে পালাতে ব্যস্ত– মৃতের সৎকার করবে কে?

নগরগুলি শেষ পর্যন্ত অধিকার করলো কারা? তারা যে লিপি-হীন প্রাক্-সভ্য ছিলো এ-বিষয়ে হরপ্পা এবং চানহুদারোর নিদর্শন থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। হরপ্পার দুটি কবরখানার নাম দেওয়া হয়েছে ‘সিমেট্রি আর-৩৭’ (Cemetery R-37) এবং ‘সিমেট্রি-এইচ্’ (Cemetery H)। হুইলারের মতে প্রথমটি অনেক পুরানো, প্রকৃত হরপ্পা-সংস্কৃতির পরিচায়ক; কিন্তু দ্বিতীয়টি অনেক পরের যুগের। কেননা দ্বিতীয়টিতে শুধু যে কবর দেবার পদ্ধতি অন্য রকম তাই নয়, এই কবরখানায় অন্যান্য এমন নিদর্শন পাওয়া গেছে যাকে কিছুতেই প্রকৃত হরপ্পা-সংস্কৃতির পরিচায়ক বলা যায় না।
এখানে প্রশ্ন হলো, দ্বিতীয় কবরখানাটা যদি প্রকৃত সিন্ধু-অধিবাসীদের না হয়, তাহলে তা কাদের কবরখানা? ১৯৪৩ সালে গর্ডন চাইল্ড একটু রয়েসয়ে মন্তব্য করেছিলেন, এ-কবরখানা আক্রমণকারী আর্যদেরই হওয়া সম্ভব। এবং প্রত্নতত্ত্বমূলক পরবর্তী কাজ– বিশেষত ১৯৪৬ সালের উৎখনন– চাইল্ডের এই মন্তব্যকেই সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।

১৯৪৪ সালে ‘আর্কিওলোজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’র মহাপরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণ করে স্যার মর্টিমার হুইলার বিভিন্ন প্রত্নস্থানে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পরবর্তী যেসব খননকাজ পরিচালনা করেন তার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে যে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয় সেখানেই সিন্ধু-সভ্যতায় আর্য-আক্রমণের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন সাক্ষ্য-নিদর্শন দৃষ্টিগোচর হয়। যেমন-

‘সিমেট্রি-এইচ্’-এর প্রত্ন-নিদর্শনগুলির সঙ্গে প্রকৃত হরপ্পা-সংস্কৃতির নিদর্শনের পার্থক্য থেকে স্বভাবতই অনুমিত হয়েছে, এগুলি কোনো এক স্বতন্ত্র সংস্কৃতির পরিচায়ক। তার নাম দেয়া হয় ‘সিমেট্রি-এইচ’ ইন্ডাস্ট্রি। ১৯৪৬ সালের প্রত্ন-খননকাজে স্পষ্টই বোঝা গেলো, হরপ্পা নগরীর ধ্বংসস্তুপের উপর বেশ অনেকখানি জঞ্জাল জমা হয়েছিলো; তারই উপর আগন্তুক ইন্ডাস্ট্রির স্বাক্ষর। তার মৃৎপাত্র অনেক নিকৃষ্ট, সে-মৃৎপাত্রের সঙ্গে সংযুক্ত গৃহনির্মাণকৌশলের যেটুকু পরিচয় তাও অনেক নিকৃষ্ট– হরপ্পা-সংস্কৃতির নির্মাণকুশলতার সঙ্গে তুলনা হয় না। এই নব্য-ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে অক্ষর-পরিচয়েরও অভাব দেখা যায়। তা ছাড়া, এই আগন্তুক ইন্ডাস্ট্রির আবির্ভাব যেন আকস্মিকভাবেই ঘটেছিলো– সিন্ধু-সভ্যতার ধ্বংসস্তুপের উপর হঠাৎ যেন উটকোর মতো এসে পড়েছিলো। এই উৎখননে আরও দেখা গেলো, হরপ্পা-নগরীর শেষদিকের পর্যায়ে রক্ষণ-ব্যবস্থাকে নতুন করে– এবং খানিকটা তাড়াহুড়ো করেই যেন– আরও পাকা-পোক্ত করে তোলবার আয়োজন হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে পিগট্-এর মন্তব্য হলো, নগরবাসীরা তখন আত্মরক্ষার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত।
কাদের আক্রমণের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা? স্বভাবতই অনুমান হয়, ‘সিমেট্রি-এইচ্’-এর সঙ্গে সংযুক্ত লিপি-হীন নির্মাণ-অনভিজ্ঞ প্রাক্-সভ্য মানবদলের আক্রমণ।


চানহুদারোর ধ্বংসস্তুপ থেকেও মোটের উপর একই ইঙ্গিত পাওয়া গেছে-
প্রথম– অর্থাৎ সর্বনিম্ন, অতএব সর্বপ্রাচীন– স্তরে অবধারিত হরপ্পা-সংস্কৃতির পরিচয়। কিন্তু দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্তর দুটিতে স্বতন্ত্র এবং আগন্তুক সংস্কৃতির সাক্ষ্য; প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের মধ্যে সময়ের ব্যবধানও সুস্পষ্ট। এর মধ্যে দ্বিতীয় স্তরটির নাম দেওয়া হয় ঝুকর-সংস্কৃতি। অর্থাৎ চানহুদারোতে হরপ্পা-সংস্কৃতির ধ্বংসস্তুপের উপর ঝুকর-সংস্কৃতির মানুষেরা আবাস স্থাপন করেছিল। কিন্তু সে-আবাসের নির্মাণকৌশল অত্যন্ত নিকৃষ্ট। তা ছাড়া, এ-সংস্কৃতির সীল, হাতিয়ার, তাবিজ প্রভৃতিও পাওয়া গিয়েছে। হরপ্পা-সংস্কৃতির সীলের উপরকার সুনিপুণ কারিগরির তুলনায় ঝুকর-সংস্কৃতির সীলগুলি শুধুই যে স্থূল ও বাজে ধরনের তাই নয়– এগুলিতে কোনো লিপির পরিচয় নেই। সিন্ধু-সাম্রাজ্যের অন্যান্য জায়গায়ও এই ঝুকর-সংস্কৃতির স্মারক পাওয়া গিয়েছে এবং সর্বত্রই তা বর্বর-অবস্থারই পরিচায়ক (পিগট্-এর অভিমত)। আরও দ্রষ্টব্য হলো, এই ঝুকর-সংস্কৃতির সীলের সঙ্গে ছবি প্রভৃতির দিক থেকে প্রাচীন হিটাইট-দের সীলের সাদৃশ্য চোখে পড়ে এবং হিটাইটদের এক চুক্তিপত্রে ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র প্রভৃতি বৈদিক দেবতাদের নাম আবিষ্কৃত হয়েছে। অতএব চানহুদারোতে হরপ্পা-সংস্কৃতির ধ্বংসস্তুপের উপর ঝুকর-সংস্কৃতির যে-বাহকেরা আবাস স্থাপন করেছিল তাদের সঙ্গে বৈদিক আর্যদের সম্পর্ক– বা যোগাযোগ– থাকা অসম্ভব নয়।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৫৫)

অত্যন্ত স্বাভাবিক যুক্তিতে এটা স্বীকার্য যে, কোনো এক বর্বর মানবদলের আক্রমণেই যদি সিন্ধু-সভ্যতা বিধ্বস্ত হয়ে থাকে তা হলে সিন্ধু-সাম্রাজ্যের অন্তর্গত অন্যান্য স্থানেও তার পরিচয় খুঁজে পাবার কথা। এবং এ-জাতীয় পরিচয় যে সত্যিই কতো প্রচুর পিগট-এর রচনায় তার বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায় বলে দেবীপ্রসাদ মন্তব্য করেন। তবে সিন্ধু-সভ্যতায় ওই আক্রমণকারী যে আর্যগোষ্ঠীই ছিলো এ-বিষয়ে স্যার মর্টিমার হুইলার ১৯৪৬ সালের উৎখননের ভিত্তিতে প্রাপ্ত প্রত্ননিদর্শন ও বৈদিক-সাহিত্যকে নজির হিসেবে উল্লেখ করে সুস্পষ্ট মন্তব্য করেছেন।

.
সিন্ধু-সভ্যতায় আর্য-আক্রমণের ঋগ্বেদ-সাক্ষ্য :

১৯৪৩ সালে গর্ডন চাইল্ড যে ‘সিমেট্রি-এইচ্’-কে বৈদিক মানুষদের কবরখানা বলে সনাক্ত করতে চেয়েছিলেন, এই প্রসঙ্গে– এবং ১৯৪৬ সালের খননকাজের ভিত্তিতে– স্যার মর্টিমার হুইলার মন্তব্য করেছেন (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের তর্জমায়)-

‘ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের পটভূমি হিসেবে ভারতীয় সাহিত্যের নজির খুঁজতে যাওয়া সব-সময়েই কিছুটা বিপজ্জনক এবং সে-বিপদের সম্ভাবনা এখানেও আছে। কিন্তু তার সম্মুখীন হতে আমি সম্পূর্ণ পরাক্সমুখ নই। সপ্তসিদ্ধু পাঞ্জাব ও তার আশপাশে আর্য-আক্রমণের বর্ণনা হিসেবে বারবার স্থানীয় অধিবাসীদের প্রাচীরবেষ্টিত নগর বিধ্বস্ত করবার কথা পাওয়া যায়। ঋগ্বেদে এই নগর বোঝাবার জন্য পুর শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আর্যদের যুদ্ধদেবতা ইন্দ্র ছিলেন পুরন্দর, পুর-ধ্বংসকারী।… জরার ফলে যে-রকম বস্ত্র বিদীর্ণ হয় ইন্দ্র সেইভাবেই পুরগুলি বিদীর্ণ করতেন। এই পুরগুলি কোথায় ছিল? আগেকার কালে ধরে নেওয়া হতো, এগুলি নেহাতই বুঝি পৌরাণিক কল্পনা, বা হয়তো বড় জোর আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে রচিত কোনোরকম অত্যন্ত স্থূল প্রাচীর-পরিখা ধরনের কিছু। হরপ্পায় সাম্প্রতিক খননকাজের ফলে এই চিত্র পরিবর্তিত হয়েছে। এখানে পাওয়া গিয়েছে এক সুউচ্চ সভ্যতার পরিচয়, সে-সভ্যতা একান্তই আর্য-পূর্ব। আমরা এখন জানতে পেরেছি যে এখানে সুবিশাল রক্ষণ-ব্যবস্থাও রচিত হয়েছিল এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের নদীগুলিকে আয়ত্তে রাখবারও আয়োজন করা হয়েছিল। এ সমস্তই হলো এমন এক যুগের কথা যা কিনা মোটামুটি আর্য-আক্রমণের সমসাময়িক। সেই সভ্যতা বিলুপ্ত হলো কী করে? জলবায়ুর অবস্থা পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের ফলে তা হয়তো দুর্বল হয়ে পড়েছিল; কিন্তু তার চূড়ান্ত বিলুপ্তির কারণ খুব সম্ভব কোনো এক ব্যাপক ও কঠিন আক্রমণ। মহেঞ্জোদারোর শেষাবস্থায় নির্বিচারে স্ত্রী-পুরুষ-শিশু হত্যার নিদর্শনও নেহাতই অহেতুক ঘটনা না হওয়াই সম্ভব। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য থেকে মনে হয়, ইন্দ্রই এ-অপরাধে অভিযুক্ত।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৫৫-৬)


কিন্তু এমন কথা কি সত্যিই কল্পনা করা যায়, ইন্দ্র-বিধ্বস্ত ওই সৌধ বলতে হরপ্পার নিদর্শনের বদলে আসলে অন্য কিছু ছিলো– হয়তো এখনও তা আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত রয়েছে? হুইলার বলছেন-

‘এ কথা কল্পনা করতে হলে দাবি করা দরকার যে হরপ্পার শেষ এবং আর্য-আক্রমণের শুরু, এই দুটি ঘটনার মধ্যবর্তী সংক্ষিপ্ত সময়টুকুর মধ্যে একই অঞ্চলে অপর কোনো এক শক্তিশালী সভ্যতা গড়ে উঠেছিল এবং আর্য আক্রমণকারীরা তারই সুবিস্তৃত রক্ষণব্যবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল। এ-জাতীয় কথা স্বীকার করা সহজ নয় এবং এ-কথা স্বীকার করতে হলে হরপ্পার রক্ষণ-ব্যবস্থা সংক্রান্ত সুস্পষ্ট নিদর্শনগুলিকে স্বেচ্ছায় অবজ্ঞা করতে হয়। অবশ্যই আরও খননকার্যের ফলেই এ-প্রশ্নের চূড়ান্ত উত্তর পাওয়া যাবে।’


এ-প্রেক্ষিতে দেবীপ্রসাদের মন্তব্য হলো- ‘হুইলারের শেষ মন্তব্যটি অবশ্যই বিনয়সূচক। কেননা ভবিষ্যতের প্রত্নতত্ত্বমূলক গবেষণার ফলে সিন্ধু-সভ্যতা সংক্রান্ত যত নতুন তথ্য পাবার সম্ভাবনাই থাকুক না কেন, ওই একই এলাকায় ওই একই যুগের কোনো এক স্বতন্ত্র সুউচ্চ সভ্যতা আবিষ্কারের সম্ভাবনা সত্যিই অবাস্তব। তা ছাড়া প্রমাণ হিসেবে অনাবিষ্কৃত তথ্যের সম্ভাবনা আবিষ্কৃত তথ্যের তুলনায় একান্তই নগন্য। প্রত্নতত্ত্বমুলক ও সাহিত্যমূলক তথ্যের মিলিত ইঙ্গিত থেকে একটি কথাই অনুমান হয় : বৈদিক মানুষদের আক্রমণে হরপ্পা-সভ্যতা বিধ্বস্ত হয়েছিল।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৫৬)

এই অনুমানের পক্ষে ঋগ্বেদের সাক্ষ্য থেকে আরো কিছু যুক্তিও প্রদর্শিত হয়েছে। যেমন, ঋগ্বেদের ষষ্ঠ মণ্ডলে একটি ঋক পাওয়া যায় যেখানে ইন্দ্রের কীর্তি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-

‘বধীদিন্দ্রো বরশিখস্য শেষোহভ্যাবর্তিনে চায়মানয় শিক্ষন্ ।
বৃচীবতো যদ্ধরিয়ূপীয়ায়াং হৎপূর্বে অর্ধে ভিয়সাপরো দর্ত্ ।।’- (ঋগ্বেদ-৬/২৭/৫)
অর্থাৎ : চয়মানের পুত্র অভাবর্তীর প্রতি অনুকূল হয়ে ইন্দ্র বরশিখের পুত্রগণকে সংহার করেছেন। তিনি হরিয়ূপীয়ার পূর্বভাগে অবস্থিত বরশিখের পুত্র বৃচীবানের বংশধরদের বধ করেন, তখন পশ্চিমভাগে অবস্থিত বরশিখের শ্রেষ্ঠ পুত্র ভয়ে বিদীর্ণ হয়েছিলো।


এখানে বিশেষ দ্রষ্টব্য হলো, উপরিউক্ত ঋকে যে নগরের নাম উল্লেখ রয়েছে- ‘হরিয়ূপীয়া’, আধুনিক বিদ্বানেরা এ-নগরকে খুব যৌক্তিকভাবেই হরপ্পা বলে সনাক্ত করতে চেয়েছেন। প্রত্ন-ইতিহাসবিদ কোশাম্বী অনুমান করেছেন, এ-যুদ্ধ আর্য এবং আর্য-পূর্বদের মধ্যেই ঘটে থাকা সম্ভব; কেননা বৃচীবানের বংশধরের কথা আর শোনা যায় না, কিন্তু ওই এলাকাতেই চয়মানের বংশধরেরা উত্তরকালেও টিকে থেকেছিলো। এই অনুমানের পক্ষে প্রাসঙ্গিক তথ্য হিসেবে স্মর্তব্য যে, আলোচ্য ঋকটির রচয়িতা কবির নাম ঋষি ভরদ্বাজ এবং ষষ্ঠ মণ্ডলেই তাঁর রচিত একটি পূর্ববর্তী ঋকে ইন্দ্র অসুরঘ্ন বা অসুরহন্তা বলে কীর্তিত। যেমন-

‘তন্নো বি বোচা যদি ভে পুরা চিজ্জরিতার আনশু সুম্নমিন্দ্র।
কস্তে ভাগঃ কিং বয়ো দুধ্র খিদ্বঃ পুরুহূত পুরূবসোহসুরঘ্নঃ।।’- (ঋগ্বেদ-৬/২২/৪)
অর্থাৎ : হে ইন্দ্র ! যদি পূর্বকালে তোমার স্তোতৃগণ সুখলাভ করে থাকেন, তবে আমাদেরও সে সুখ প্রদান করো। হে দুর্ধর্ষ, শত্রুবিজয়ী, ঐশ্বর্যশালী পুরুহূত ! তুমি অসুরনিহন্তা, তোমার জন্য কোন ভাগ ও কোন হব্য কল্পিত হয়েছে।


অতএব অনুমান হয় আলোচ্য পূর্বোক্ত ঋকেও ইন্দ্র অসুরঘ্ন বা অসুর-হত্যাকারী হিসেবেই বৃচীবানের পুত্রদের বধ করেন। বেদ-টীকাকার সায়ণাচার্যও বরশিখকে অসুর বলেছেন। এবং ঋগ্বেদে এখানে অসুর বলতে অবশ্যই আর্যপূর্ব বা অনার্যদের বোঝানো হয়েছে। এই অনার্যদেরকেই ঋগ্বেদে কখনো বা দস্যু কিংবা বিরুদ্ধবাদী হিসেবেও উল্লেখ আখ্যায়িত করা হয়েছে যাদেরকে ইন্দ্র হত্যা করেছেন, যেমন-

‘সসানাত্যা উত সূর্যং সসানেন্দ্রঃ সসান পুরুভোজসং গাম্ ।
হিরণ্যয়মুত ভোগং সসান হত্বী দস্যুন্প্রার্যং বর্ণমাবৎ।।’ (ঋগ্বেদ-৩/৩৪/৯)
‘ইন্দ্র ওষধীরসনোদহানি বনস্পতীরসনোদস্তরিক্ষম্ ।
বিভেদ বলং নুনুদে বিবাচোহথাভবন্দমিতাভিক্রতুনাম্ ।।’ (ঋগ্বেদ-৩/৩৪/১০)
অর্থাৎ :
ইন্দ্র অশ্বদান করেছেন, সূর্য দান করেছেন, বহু লোকের উপভোগযোগ্য গোধন দান করেছেন, দস্যুদের বধ করে আর্যবর্ণকে রক্ষা করেছেন (ঋক-৩/৩৪/৯)।  ইন্দ্র ওষধি প্রদান করেছেন, দিবস প্রদান করেছেন, বনস্পতি ও অন্তরীক্ষদের প্রদান করেছেন। তিনি মেঘ ভেদ করেছেন, বিরুদ্ধবাদীদের বধ করেছেন, যারা অভিমুখে যুদ্ধ করতে আসে তাদের বধ করেছেন (ঋক-৩/৩৪/১০)।


পুরন্দর ইন্দ্র যে শত্রুর শত শত পুর, পুরী ও হর্ম্য বা প্রাসাদ ভেদ ও ধ্বংস করেছেন তার নমুনা ঋগ্বেদ জুড়ে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে, যেমন-

‘যুধা যুধমুপ ঘেদেষি ধৃষ্ণুয়া পুরা পুরং সমিদং হংস্যোজসা।
নম্যা যদিন্দ্র সখ্যা পরাবতি নিবর্হয়ো নবুচিং নাম মায়িনম্ ।।’ (ঋগ্বেদ-১/৫৩/৭)
‘ত্বং করঞ্জমুত পর্ণয়ং বধীস্তেজিষ্ঠযাতিথিগ্বস্য বর্তনী।
ত্বং শতা বঙ্গৃদস্যাভিনত্পুরোহনানুদঃ পরিষূতা ঋজিশ্বনা।।’ (ঋগ্বেদ-১/৫৩/৮)
‘ত্বং পিপ্রুং মৃগয়ং শূশুবাংসমৃজিশ্বনে বৈদথিনায় রন্ধীঃ।
পঞ্চাশৎকৃষ্ণা নি বপঃ সহস্রাৎকং ন পুরো জরিমা বি দর্দঃ।।’ (ঋগ্বেদ-৪/১৬/১৩)
‘অহং পূরো মন্দসানো ব্যৈরং নব সাকং নবতীঃ শম্বরস্য।
শমতমং বেশ্যং সর্বতাতা দিবোদাসমতিথিগ্বং যদাবম্ ।।’ (ঋগ্বেদ-৪/২৭/৩)
অর্থাৎ :
হে ইন্দ্র ! তুমি শত্রুবর্ষণকারীরূপে যুদ্ধ হতে যুদ্ধান্তরে গমন কর, বলদ্বারা নগরের পর নগর ধ্বংস কর। হে ইন্দ্র! তুমি নথী ঋষির সহায়ে দূর দেশে মনুচি নামক মায়াবী অসুরকে বধ করেছিলে (ঋক-১/৫৩/৭)।  তুমি অতিথিগ্ব নামক রাজার জন্য করঞ্জ ও পর্ণয় নামক অসুর শত্রুদ্বয়কে তেজস্বী বর্তনী দ্বারা বধ করেছ; তারপর তুমি অনুচর রহিত হয়ে ঋজিশ্বান নামক রাজার দ্বারা চারদিকে বেষ্টিত বঙ্গৃদ নামক অসুর শত্রুর শত নগর ভেদ করেছিলে (ঋক-১/৫৩/৮)।  তুমি পিপ্রু ও প্রবৃদ্ধ মৃগয়কে বিনাশ করেছিলে, তুমি সকলকে বিদথীর পুত্র ঋজিশ্বার বশীভূত করেছিলে। তুমি পঞ্চাশৎ সহস্র কৃষ্ণবর্ণ অনার্য শত্রুকে বিনাশ করেছিলে। জরা যেরূপ রূপ বিনাশ করে, তুমি সেরূপ শম্বরের নগরসমূহ বিনাশ করেছিলে (ঋক-৪/১৬/১৩)।  (আপনার কীর্তি বর্ণনা করে ইন্দ্র বলছেন) আমি সোমপানে মত্ত হয়ে শম্বরের নবনবতি বা নিরানব্বই সংখ্যক পুরী এককালে ধ্বংস করেছি। আমি যখন অতিথিগ্ব দিবোদাসকে যজ্ঞে পালন করেছিলাম তখন তাকে শততম পুরী বাসের জন্য দিয়েছিলাম (ঋক-৪/২৭/৩)।


এমন অসামান্য কীর্তির জন্যেই হয়তো ইন্দ্রকে পুরন্দর বা পুর-ধ্বংসকারী বলা হয়। কিন্তু কোথায় এসব পুর ধ্বংস হয়েছে? ঋগ্বেদে সেভাবে স্থানের নাম সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও সিন্ধু, যমুনা, সরস্বতি, শতদ্রু, পরুষ্ণি (ইরাবতি, রাভী), বিতস্তা ইত্যাদি অন্তত উনিশটি নদীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া সপ্তনদী বা সপ্তসিন্ধুরও বেশ কয়েকবার উল্লেখ রয়েছে। যা থেকে ধারণা করা হয়, আর্যদের আবাস তৈরি হয়েছিলো সপ্তসিন্ধুর দেশে  অর্থাৎ, বর্তমান পশ্চিম পাকিস্তান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা ছাড়াও আফগানিস্তানের কিছু অংশ বিস্তৃত। ঋগ্বেদের নদী সূক্তের (ঋগ্বেদ-১০/৭৫) পঞ্চম ঋকে সিন্ধু নদীর পূর্বদিকের অর্থাৎ পাঞ্জাব প্রদেশের শাখাগুলির নাম এবং ষষ্ঠ ঋকে পশ্চিম দিকের অর্থাৎ কাবুল প্রদেশের শাখাগুলির নাম পাওয়া যায়। এছাড়া গঙ্গা ও যমুনার অববাহিকাতেও যে আর্যদের বসতি বিস্তার লাভ করেছিলো তা অনুমান করা যায়। যেমন-

‘আ যৎসাকং যশসো বাবশাসাঃ সরস্বতী সপ্তথী সিন্ধুমাতা।
যাঃ সুষ্বয়ন্ত সুদুঘাঃ সুধারা অভি স্বেন পয়সা পীপ্যানাঃ।।’ (ঋগ্বেদ-৭/৩৬/৬)
‘অভি ত্বা সিন্ধো শিশুমিন্ন মাতরো বাশ্রা অর্ষন্তি পয়সেব ধেনবঃ।
রাজেব যুধ্বা নয়সি ত্বমিৎসিচৌ যদাসামগ্রং প্রবতামিনক্ষসি।।’ (ঋগ্বেদ-১০/৭৫/৪)
‘ইমং মে গঙ্গে যমুনে সরস্বতি শুতুদ্রি স্তোমং সচেতা পুরুষ্ণ্যা।
অসিক্ল্যা মরুদ্বুধে বিতস্তয়ার্জীকীয়ে শৃণুহ্যা সুষোময়া।।’ (ঋগ্বেদ-১০/৭৫/৫)
‘তৃষ্টাময়া প্রথমং যাতবে সজূঃ সুসর্ত্বা রসয়া শ্বেত্যা ত্যা।
ত্বং সিন্ধা কুভয়া গোমতীং ক্রুমুং মেহৎস্বা সরথং যাভিরীয়সে।।’ (ঋগ্বেদ-১০/৭৫/৬)
‘ঋৃজীত্যেনী রুশতি মহিত্বা পরি জ্রয়াংসি ভরতে রজাংসি।
অদঝ্বা সিন্ধৃরপসামপস্তমাশ্বা ন চিত্রা বপুষীব দর্শতা।।’ (ঋগ্বেদ-১০/৭৫/৭)
‘স্বশ্বা সিন্ধুঃ সুরথা সুবাসা হিরণ্যয়ী সুকৃতো বজিনীবতী।
ঊর্ণাবতী যুবতিঃ সীলমাবত্যুতাধি বস্তে সুভগা মধূবৃধম্ ।।’ (ঋগ্বেদ-১০/৭৫/৮)
অর্থাৎ :
যে নদীগণের মধ্যে সিন্ধু মাতা ও সরস্বতী সপ্তম স্থানীয়া সে কামদুঘা সুধারা নদীগণ প্রবাহিত হচ্ছে। স্বীয় জলে বর্তমান ও অন্নবিশিষ্ট ও কাময়মান নদীসকল যুগপৎ আসুন (ঋক-৭/৩৬/৬)।  হে সিন্ধু ! যেমন শিশু বৎসের নিকট তাদের জননী গাভীর দুগ্ধ নিয়ে যায় সেরূপ আর আর নদী শব্দ করতে করতে জল নিয়ে তোমার চতুর্দিকে আসছে। যেমন যুদ্ধ করবার সময় রাজা সৈন্য নিয়ে যায় সেরূপ তোমার সহগামিনী এ দুটি নদী শ্রেণীকে নিয়ে তুমি অগ্রে অগ্রে চলেছ (ঋক-১০/৭৫/৪)।  হে গঙ্গা ! হে যমুনা সরস্বতী শতদ্রু ও পরুষ্ণি ! আমার এ স্তবগুলি তোমরা ভাগ করে নাও। হে অসিক্লী-সঙ্গত মরুদবৃধা নদী ! হে বিতস্তা ও সুষোমা সঙ্গত আর্জীকীয়া নদী ! তোমরা শোন (১০/৭৫/৫)।  হে সিন্ধু ! তুমি প্রথমে তৃষ্টামা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে চললে। পরে সুসর্ত্তু ও রসা ও শ্বেতীর সাথে মিললে। তুমি ক্রমু ও গোমতীকে, কুভা ও মেহৎনুর সাথে মিলিত করলে। এ সকল নদীর সঙ্গে তুমি এক রথে অর্থাৎ একত্রে গিয়ে থাক (ঋক-১০/৭৫/৬)।  এ দুর্ধর্ষ সিন্ধু সরলভাবে যাচ্ছে, তাঁর বর্ণ শুভ্র ও উজ্জ্বল, তিনি অতি মহৎ, তাঁর জল সকল মহাবেগে গিয়ে চতুর্দিক পরিপূর্ণ করছে। যত গতিশালী আছে, এঁর তুল্য গতিশালী কেউ নেই। ইনি ঘোটকীর ন্যায় অদ্ভূত, ইনি স্থূলকায়া, রমণীর ন্যায় সৌষ্ঠবদর্শনা (ঋক-১০/৭৫/৭)।  সিন্ধু চিরযৌবনা ও সুন্দরী, এঁর উৎকৃষ্ট ঘোটক, উৎকৃষ্ট রথ এবং উৎকৃষ্ট বস্ত্র আছে, সুবর্ণের অলঙ্কার আছে, ইনি উত্তমরূপে সজ্জিত হয়েছেন। এঁর বিস্তর অন্ন আছে, বিস্তর পশুলোম আছে, এঁর তীরে সীলমা খড় আছে। ইনি মধু প্রসবকারী পুষ্পের দ্বারা আচ্ছাদিত (ঋক-১০/৭৫/৮)।


অতএব, এই সিন্ধু উপত্যকাবাসী অনার্যদের উপর আক্রমণকারী আর্য-সেনাপতি ইন্দ্র যে এ-অঞ্চলেরই বহু নগরী ধ্বংস করেছিলো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রত্নতাত্ত্বিক ও প্রাচীন সাহিত্য নিদর্শন থেকে অনুমান হওয়া মোটেও অসঙ্গত নয় যে, আর্য-আক্রমণেই সিন্ধু-সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিলো। এ-প্রেক্ষিতে সিন্ধু-সভ্যতার ধ্বংস প্রসঙ্গে কোশাম্বী আরও মৌলিক একটি প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন-

‘সহস্র বছরের পুরানো ইতিহাস সত্ত্বেও সিন্ধু-সভ্যতার নগরগুলি অমন আকস্মিকভাবে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলো কী করে? শুধুমাত্র যুদ্ধে পরাজয়ই তার সমগ্র কারণ হতে পারে না। কেননা, যে মূল অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর নগরগুলি প্রতিষ্ঠিত ছিল তা অক্ষুণ্ন থাকলে যুদ্ধে পরাজয় সত্ত্বেও নগরগুলি ঐভাবে নিঃশেষ হয়ে যেতনা। অতএব অনুমান হয়, আর্য-আক্রমণের ফলে শুধুই যে সিন্ধু-সভ্যতার অধিবাসীরা পরাস্ত হয়েছিল তাই নয়, খাদ্য-উৎপাদনের প্রধানতম পদ্ধতিও বিধ্বস্ত হয়েছিল।’ (দেবীপ্রসাদ/ ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৫৭)


তার মানে, সিন্ধু-সভ্যতার মূল অর্থনৈতিক ভিত্তি বলতে যেহেতু সুবিস্তৃত কৃষিকাজ, সেক্ষেত্রে ওই বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে কৃষিকাজের জন্য কোনো-না-কোনো রকম জলসেচ ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিলো। এই উদ্দেশ্যে নিশ্চয়ই সিন্ধু-উপত্যকার নদীগুলির শাখা-উপশাখায় বাঁধ দিয়ে বন্যার জল রুখে রাখার আয়োজন করা হতো বলে কোশাম্বী মনে করেন। ঋগ্বেদের সাক্ষ্য থেকে বোঝা যায়, বৈদিক মানুষেরা শুধুমাত্র সিন্ধু-সভ্যতার পুরগুলিই ধ্বংস করেনি; তা ছাড়াও কৃষিকাজের পক্ষে অপরিহার্য ওই বাঁধগুলিও ভেঙে দিয়েছিলো। ফলে ধ্বংস হয়েছিলো সিন্ধু-সভ্যতার অর্থনৈতিক ভিত্তি। এ-বিষয়ে কোশাম্বী ঋগ্বেদের প্রমাণও উদ্ধৃত করেছেন।

‘ইন্দ্রের কীর্তি-বর্ণনায় ঋগ্বেদ-এ বারবার বলা হয়েছে, তিনি জলস্রোতকে মুক্তি দিয়েছিলেন। ম্যাক্স-মূলার-এর যুগে এ-বর্ণনাকে প্রাকৃতিক ঘটনামূলক পৌরাণিক কাহিনীই মনে করা হয়েছে– বৃষ্টি দেবতা যেন মেঘের অবরোধ ভেঙে বৃষ্টির জল মুক্ত করেছেন। কিন্তু ঋগ্বেদের প্রকৃত বর্ণনা এ-ব্যাখ্যা মোটেই সমর্থন করে না। কেননা সে-বর্ণনা অনুসারে, এইভাবে জলস্রোতকে মুক্ত করবার জন্য ইন্দ্র বৃত্র-কে বধ করেছিলেন। বৃত্র বলতে সাধারণত কোনো দানব-নাম বোঝা হয়। কিন্তু সম্প্রতি অত্যন্ত দক্ষ দু’জন ভাষাতত্ত্ববিদ এই শব্দটি বিশ্লেষণ করেছেন। নিছক ভাষাতত্ত্বমূলক সাক্ষ্যর উপর নির্ভর করেই তাঁরা প্রমাণ করেছেন বৃত্র অর্থে কোনো দানব বোঝা ঠিক নয়– শব্দটির প্রকৃত অর্থ হলো ‘বাধা’, ‘বাঁধ’। ঋগ্বেদের বৃত্র-বিনাশ বর্ণনাও এই অর্থই সমর্থন করে : ঢালু জমিতে বৃত্র সাপের মতো শুয়ে রয়েছে, তাই নদীস্রোত বাধা পেয়ে থেমে গিয়েছে। ইন্দ্র যখন বজ্রের সাহায্যে তাকে আঘাত করলেন জমি কুঁচকে উঠল, পাথরগুলো রথের চাকার মতো গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল আর বৃত্রর এলিয়ে-পড়া দেহের উপর দিয়ে বয়ে গেল বাধামুক্ত জলস্রোত। বাঁধ ধ্বংস করবার বর্ণনা, সন্দেহ নেই।’ (ঐ/ ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৫৭)


ইন্দ্রের যুদ্ধবাজ বা অনার্যহন্তারক ইত্যাদি হিসেবে প্রসিদ্ধি থাকলেও পুরন্দর বা পুর-ধ্বংসকারী ও বৃত্র-হননকারী হিসেবেই ইন্দ্রের পরিচিতি সর্বাধিক কীর্তিত। কিন্তু ঋগ্বেদের অন্যতম আরেকটি ঋকে পুরী ভগ্নের সাথে সাথে বৃত্রকে ইন্দ্র-কর্তৃক হত্যার বদলে (কোশাম্বীর বর্ণনার অনুরূপ) চূর্ণকরার কথাই স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে সায়ণাচার্যের টীকা তর্জমায়, যেমন-

‘আ ক্ষোদো মহি বৃতং নদীনাং পরিষ্ঠিতমসৃজ ঊর্মিমপাম্ ।
তাসামনু প্রবত ইন্দ্র পন্থাম্ প্রার্দয়ো নীচীরপসঃ সমুদ্রম্ ।। (ঋগ্বেদ-৬/১৭/১২)।
অয়া হ ত্যং মায়য়া বাবৃধানং মনোজুবা স্বতবঃ পর্বতেন।
অচ্যুতা চিদ্বীলিতা স্বোজা রূজো বি দৃড়্হা ধৃষতা বিরপ্শিন্ ।।’ (ঋগ্বেদ-৬/২২/৬)।
অর্থাৎ :
হে ইন্দ্র ! তুমি বৃত্র কর্তৃক সমাচ্ছাদিত নদী সকলের প্রকাণ্ড বারিরাশি উন্মুক্ত করেছ; তুমি জলরাশি মুক্ত করেছ। তুমি সে সমস্ত নদীকে নিম্নপথে প্রবাহিত করেছ; তুমি বেগবান সলিলরাশিকে সমুদ্রে নিয়ে গিয়েছ। (ঋক-৬/১৭/১২)।।  হে নিজবলে বলীয়ান ইন্দ্র ! তুমি এ মায়াদ্বারা প্রবৃদ্ধ, প্রসিদ্ধ বৃত্রকে পর্বযুক্ত ও মনোবৎ বেগগামী বজ্রদ্বারা চূর্ণ করেছ। হে শোভন দীপ্তিশালী মহেন্দ্র ! তুমি নিজ দুর্ধর্ষ বজ্রদ্বারা অক্ষয়, অশিথিল ও দৃঢ় পুরী সকল ভগ্ন করেছ। (ঋক-৬/২২/৬)।।


এছাড়াও ঋগ্বেদে কৃত্রিম বাঁধ ভেঙে দেয়া ও নদীর নির্গমন দ্বার খুলে দেয়া প্রসঙ্গে আরো বলা হয়েছে-

‘সদ্মেব প্রাচো বি মিমায় মানৈর্বজ্রেণ খান্যতৃণন্নদীনাম্ ।
বৃথাসৃজৎপথিভির্দীর্ন্তয়াথৈঃ সোমস্য তা নদ ইন্দ্রশ্চকার।।’ (ঋগ্বেদ-২/১৫/৩)
‘ভিনদ্বলমঙ্গিরোভির্গৃণানো বি পর্বতস্য দৃংহিতান্যৈরৎ।
রিণক্ রোধাংসি কৃত্রিমাণি এষাং সোকস্য তা মদ ইন্দ্রশ্চকার।।’ (ঋগ্বেদ-২/১৫/৮)
অর্থাৎ :
তিনি (ইন্দ্র) যজ্ঞগৃহের ন্যায় পরিমাণ করে লোক সকলকে প্রাঙ্মুখ করে নির্মাণ করেন, তিনি বজ্রদ্বারা নদীর নির্গমন দ্বার সকল খুলে দেন, তিনি অনায়াসে দীর্ঘকাল গন্তব্য পথে নদী সকলকে প্রেরণ করেন, সোমজনিত হর্ষ উপস্থিত হলে ইন্দ্র এ সকল কর্ম করেছিলেন (ঋক-২/১৫/৩)।  অঙ্গিরাগণ স্তব করলে ইন্দ্র বলকে বিদীর্ণ করেছিলেন। পর্বতের দৃঢ়ীকৃত দ্বার উদ্ঘাটিত করেছিলেন। এদের কৃত্রিম রোধ বা বাঁধগুলিও ভেঙে দিয়েছিলেন। সোমজনিত হর্ষ উৎপন্ন হলে ইন্দ্র এ সকল কর্ম করেছিলেন (ঋক-২/১৫/৮)।


অতএব, সিন্ধু-সভ্যতার উৎখননে প্রাপ্ত প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন ও প্রাচীন বৈদিক সাহিত্য নিদর্শনের সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ববিদেরা মোটামুটি একমত যে, বেশ আগে থেকেই সিন্ধু-সভ্যতায় অবক্ষয় শুরু হলেও চূড়ান্তভাবে আর্য-আক্রমণের ফলশ্রুতিতেই সিন্ধু-সভ্যতার ধ্বংস পূর্ণতা পায়।

(চলবে…)
[ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]

[আগের পর্ব :  লিঙ্গ উপাসনা] [*] [পরের পর্ব : সিন্ধু-সভ্যতা ও আর্য-সভ্যতার তুলনামূলক বৈশিষ্ট্য]

[ চার্বাকের খোঁজে অধ্যায়সূচি ]

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

রণদীপম বসু


‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভাল।...’
.
.
.
(C) Ranadipam Basu

Blog Stats

  • 1,234,644 hits

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 188 other subscribers
Follow h-o-r-o-p-p-a-হ-র-প্পা on WordPress.com

কৃতকর্ম

সিঁড়িঘর

দিনপঞ্জি

জুলাই 2015
রবি সোম বুধ বৃহ. শু. শনি
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031  

Bangladesh Genocide

1971 Bangladesh Genocide Archive

War Crimes Strategy Forum

লাইভ ট্রাফিক

ক’জন দেখছেন ?

হরপ্পা কাউন্টার

Add to Technorati Favorites

গুগল-সূচক

Protected by Copyscape Web Plagiarism Check

Flickr Photos