h-o-r-o-p-p-a-হ-র-প্পা

| চাণক্যজন কহেন…০৪ |নীতিকথা-০১|

Posted on: 16/03/2012


.
| চাণক্যজন কহেন…০৪ |নীতিকথা-০১|
-রণদীপম বসু
বিদ্বত্ত্বঞ্চ নৃপত্বঞ্চ নৈব তুল্যং কদাচন।
স্বদেশে পূজ্যতে রাজা বিদ্বান্ সর্বত্র পূজ্যতে।। ০১।। (চাণক্য নীতিশাস্ত্র)।
অর্থাৎ : বিদ্যাবত্তা এবং রাজপদ কখনোই সমান হয় না। রাজা কেবলমাত্র নিজ রাজ্যেই সম্মান পান, বিদ্বান (স্বদেশ-বিদেশ) সর্বত্র সম্মান পান।
.
চাণক্য নীতিশাস্ত্রের প্রথম শ্লোক এটি। শ্লোকটির বহুল ব্যবহৃত দ্বিতীয় চরণটা আমাদের কাছে খুবই পরিচিত মনে হওয়ার কথা। কারণ, ‘স্বদেশে পূজিত রাজা, বিদ্বান সর্বত্র’- এরকম একটা ভাবসম্প্রসারণের বিষয় মাধ্যমিক ক্লাসের জন্য যথার্থই বলা চলে। এবং মজার বিষয় হলো, এরকম একটা বিষয় নিয়ে ভাবতে বসলে আমরা যে-যত বিদ্যাদিগ্গজই হয়ে উঠি না কেন, বিশেষ ব্যতিক্রম বাদ দিলে, আমাদের মাধ্যমিক পর্যায়ের জ্ঞানটাই খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে আমাদের নির্দ্বিধ ব্যাখ্যাটা এগিয়ে যেতে থাকবে এভাবে- বিদ্বানের সম্মান সর্বত্রই। নিজের দেশে বিদ্বান ও রাজা দুজনেই সম্মান ও মর্যাদা পেলেও বিদ্বানের সম্মান কিন্তু নিজ দেশের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। রাজা স্বদেশে ক্ষমতা ও আধিপত্যের জোরে যে সম্মান আদায় করে নেন, বিদেশে এই সম্মান না-ও পেতে পারেন। এখানেই বিদ্বান ও রাজার মধ্যে পার্থক্য এবং ইত্যাদি ইত্যাদি…।
.
কেন ? নিরবচ্ছিন্ন কথার মাঝখানে এরকম দুর্মুখের মতো ছোট্ট একটা প্রশ্ন আমাদের মাধ্যমিক পর্যায়ের জ্ঞানস্রোতকে মুহূর্তের জন্যে থমকে দেয়াটা অসম্ভব নয়। কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়েই এর উত্তর দেয়ার একটা চেষ্টা করবো নিশ্চয়ই। হয়তো এভাবেই বলবো তখন- যিনি সম্যক বিদ্যা অর্জন করেন তিনিই বিদ্বান। যেহেতু বিদ্যা সকল দেশেই প্রার্থিত, তাই বিদ্যার সম্মান সর্বত্রই রয়েছে। কিন্তু রাজা হলেই যে তিনি বিদ্বান হবেন এমন তো কথা নেই ! অতএব রাজা এবং বিদ্বানের মধ্যে পার্থক্য তো একটা রয়েছেই !
.
একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে যে, আমাদের চিন্তাস্রোত কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায় ছেড়ে আরেকটু উপরের দিকে উড্ডীন হয়ে গেছে। এবং এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে তখনই যখন মূর্খের মতো আরেকটা বেয়ারা প্রশ্ন এসে খাড়ার মতো সামনে দাঁড়িয়ে যাবে- বিদ্যা কী ? তাই তো ! পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে জুতসই উত্তর লিখার জন্য কয়েক গাদা বইয়ের পাতা মুখস্ত করাই কি বিদ্যা ? কিন্তু তা কেন হবে ! তাহলে বিদ্যা কি বড় বড় কিছু সনদ বা প্রশংসাপত্র ? তাও নিশ্চয়ই নয়। তাহলে কী ? ফাঁক গলে কেউ হয়তো এরকম একটা উত্তর নিয়ে হাজির হয়ে যেতে পারেন যে- কোনো বিষয়ে বিশেষ যে জ্ঞান তা-ই বিদ্যা। কিন্তু এতেও কি স্থির থাকার উপায় আছে ? প্রশ্নের সমস্যাটাই হলো একবার শুরু হয়ে গেলে তা থামানো মোটেও সহজ হয় না। কোন্ বিষয়ে জ্ঞান, কী ধরনের জ্ঞান, কেন এ জ্ঞান, এ জ্ঞান কোন্ পর্যায়ে আহরিত হলে তাকে বিদ্যা বলা হবে, কেন এ বিদ্যাকে সর্বত্র পূজিত হতে হবে, এ বিদ্যা কি চিরায়ত ? ইত্যাদি ইত্যাদি প্রচুর ডালপালা বিস্তৃত হতেই থাকবে যতক্ষণ না তাকে একটা সন্তোষজনক সংজ্ঞায় আবদ্ধ করা যায়। এবং এখানেও সন্দেহ, আদৌ কি কোনো সংজ্ঞায় আবদ্ধ করা সম্ভব ?
.
ফাঁকতালে আরেকটা কথা বলে রাখা মনে হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, এককালে জ্যোতিষশাস্ত্র নামক ভয়ানক গুরুত্ববহ একটা বিদ্যাকে একালের আলোকে মুক্তচিন্তক জ্ঞানপিপাসুরা সম্পূর্ণ প্রতারণা ও ভাওতাবাজিপূর্ণ একটি অপবিদ্যা হিসেবেই চিহ্নিত করেন। অতএব যুগে যুগে বিদ্বান বা জ্ঞানীর সংজ্ঞাতেও যে এরকম অনেক মোহন হেঁয়ালির বিভ্রম মিশে থাকতে পারে, সেদিকেও সতর্ক থাকার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে না কখনোই।
.
তাহলে শুরুতেই আমরা যে নীতিবাক্যটিকে আমাদের জটিলতামুক্ত ভাবনায় স্রেফ সহজ সরল একটা মনোরম বাক্য বলেই ধরে নিয়েছিলাম, আদতে কি তা ? আর কূটতর্ক জুড়ে গেলে আসলে কোন কিছুই যে জটিলতামুক্ত থাকে না, সেটাও ভাবনার বিষয়। তবে এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, উদ্ধৃত শ্লোকটি শুধুমাত্র একটি বচনই নয়। মানবসভ্যতার প্রাচীন জ্ঞানজগতের এক অসামান্য প্রতিভাধর বিদ্বান ও প্রাজ্ঞ দার্শনিক কৌটিল্য তথা চাণক্যের নীতিশাস্ত্রের অন্যতম শ্লোক এটি। এরকম অনেকগুলো শ্লোকের সমাহার হলো সেই নীতিশাস্ত্র, প্রায় আড়াইহাজার বছর পেরিয়ে এসেও আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি-সভ্যতায় অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে আছে যার অতুলনীয় অবদান। কী এমন আশ্চর্য জারকরস নিহিত এসব শ্লোকের মধ্যে, তা উপলব্ধিরও বিষয় বৈ কি। অন্তত পরবর্তী শ্লোকগুলোর যথার্থ মাহাত্ম্য অনুধাবনের প্রয়োজনেই এ পর্যায়ে প্রাথমিক কিছু সুলুকসন্ধান করা অনুচিত হবে না বোধ করি।
.
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, নীতিবাক্যের উদ্দেশ্য হলো আকর্ষণীয় উপায়ে কিছু উপদেশ বিতরণ বা নীতির প্রচার। আর  তা নির্ভর করে এই নীতিগুলোর রচয়িতা বা প্রচারকের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, সামাজিক অবস্থান এবং তৎকালীন প্রেক্ষাপটের উপর। কোন প্রক্ষিপ্ত সংযুক্তি না হয়ে প্রকৃতই এটা যদি চাণক্যের শ্লোক হয়ে থাকে, তাহলে চাণক্যের অধিষ্ঠানকাল বিবেচনায় শ্লোকটির রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকই বলতে হবে। তখনকার সামাজিক আবহটা কী ছিলো তবে ?
.
ধর্মীয় বর্ণবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রবল আধিপত্যের যাতাকলে পিষ্ট তৎকালীন সমাজ তখন খণ্ড-বিখণ্ডে বিভাজিত। একদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসনের স্বঘোষিত মুখপাত্র উচ্চবর্ণীয় আর্য ব্রাহ্মণ বা দ্বিজ (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য) সম্প্রদায়ের হাতে শাসনদণ্ড, অন্যদিকে সমাজের সরাসরি উৎপাদন-সংশ্লিষ্ট বৃহত্তর সাধারণ জনগোষ্ঠী যাদেরকে শুধু অনার্য বানিয়েই ক্ষান্ত হতে পারেনি এরা, তথাকথিত এক স্রষ্টা ব্রহ্মার আজগুবি গল্প ফেঁদে কাল্পনিক পূর্বজন্মের কৃতকর্মের ধর্মীয় দোহাই তোলে সুকৌশলে তাদেরকে নিম্নবর্গীয় শূদ্র বানিয়ে রাখা হয়েছে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত করে আক্ষরিক অর্থেই ভয়ঙ্কর এক ক্রিতদাস্যের শৃঙ্খলে। এবং এরা যাতে কখনোই একাট্টা বিদ্রোহী হয়ে এই অপশাসন-ব্যবস্থার জন্যে হুমকী হয়ে উঠতে না পারে সে লক্ষ্যে এই ব্রাত্য জনগোষ্ঠীকে আরো অনেক অনেক সামাজিক বিভাজনে পরস্পর বিভাজিত করে ভেঙে দিতে চেয়েছে তাদের মেরুদণ্ডের সবকটা কশেরুকা। আর এই ধর্মবাদী নিরঙ্কুশ শাসন নির্বিঘ্নে পরিচালনার লক্ষ্যে উপনিষদীয় ঋষি-ব্রাহ্মণদের হাতে রচিত হয়ে গেছে বেশ কিছু মোহনীয় শাস্ত্র, দর্শন এবং এর ভূরিভূরি ভাববাদী ব্যাখ্যাও। আর নিকৃষ্ট শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ রয়েছে সকল ধরনের বিদ্যার্জন, শাস্ত্রপাঠ বা জ্ঞান অর্জনের যেকোন নগন্য সুযোগও। কেননা এরা এই সুযোগ পেলে বুঝে যাবে শাস্ত্রীয় ভণ্ডামির ফোকর-ফাকর, তছনছ হয়ে যাবে এতোকালের পরনির্ভরশীলতায় গড়ে তোলা যথেচ্ছ ভোগের অবারিত সাম্রাজ্য-সৌধ।
.
কিন্তু তাতেও কি নিরাপদ থেকেছে তারা ? খুব স্বাভাবিকভাবেই শ্রমে-ঘামে ভেজা ব্রাত্য জনগোষ্ঠী কখনোই মেনে নিতে চায়নি তা। তারা তাদের জীবনচর্চার প্রত্যক্ষ উপাদান লোকায়ত আচার-বিচারকে অবলম্বন করেই গড়ে তুলেছে এক অন্যরকম বিদ্রোহের দেয়াল। ব্রাহ্মণ্যবাদী ভণ্ডামির অন্তঃসারশূন্যতাকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে সৃষ্টি করেছে এক প্রতিবাদী দর্শন- যার নাম লোকায়ত দর্শন। মাটির সন্তান বলেই মৃত্তিকার রসসিঞ্চিত প্রত্যক্ষবাদী দৃষ্টিতে এরা পরাশ্রয়ী ব্রাহ্মণ্যবাদী ভাওতাবাজির সমস্ত কাল্পনিক উৎসকে সরাসরি অস্বীকার  করে লোকায়ত চার্বাক দর্শনের নামে যুক্তির যে ধারালো বল্লম তুলে নিয়েছে হাতে, তা যে আর হেলাফেলার নয়, বড় শক্ত ভিতের উপর দাঁড়ানো, তা বুঝতে একটুও দেরি হয়নি ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকদের। ফলে ব্রাহ্মণ্যবাদী শাস্ত্র, ধর্ম, দর্শনেও এসেছে নতুন ঢাল। তাদের চোখে সেই লোকায়তিকরা হয়েছে নাস্তিক, কারণ ওরা বেদ মানে না। প্রত্যক্ষের বাইরে কোন কিছুই বিশ্বাস করে না ওরা, তাই ব্রাহ্মণ্যবাদের চোখে ওদের শানিত যুক্তি চিহ্নিত হয়েছে হেতুবিদ্যা বা অসৎ-তর্ক নামে।
.
এখন প্রশ্ন আসে, যুক্তির ধারে শানিত এই হেতুবিদ্যা কি প্রকৃতই কোন অজ্ঞ শাস্ত্রবিমুখ মূর্খের দ্বারা সৃষ্ট হওয়া সম্ভব ছিলো ? ব্রাহ্মণের অষ্টপ্রহর সেবায় নিয়োজিত আক্ষরিক গাধার মতো খেটে যাওয়া কোনরূপ শিক্ষার ন্যূনতম সুযোগহীন ক্রিতদাস শূদ্রদের দ্বারা নিশ্চয়ই এরকম সুশিক্ষিত উচ্চকোটির শাস্ত্র রচিত হওয়া সম্ভব ছিলো না। অর্থাৎ যে কোন অবস্থান থেকেই যুগে যুগে মানবদরদী মানবতাবাদী মুক্তচিন্তক কিছু মানুষের উত্থান সর্বকালেই হয়েছে যাঁরা মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে এগিয়ে এসেছেন সবকিছু তুচ্ছ করে কেবলই মানবজন্মের দায়ভার কাঁধে নিয়ে। তাঁদের শরীরেও মাটির সোঁদা গন্ধই ছিলো নিশ্চয়ই। প্রাথমিক চার্বাকরা সেই বিরল গোত্রেরই মানুষ। অন্য দৃষ্টিতে তাঁদেরকে বার্হষ্পত্যও বলা হয়। এরা নাস্তিক। নইলে ব্রাহ্মণ্যবাদী সকল শাস্ত্রের সাংবিধানিক আকরগ্রন্থ ‘মনুসংহিতা’য় কেন স্পষ্ট উল্লেখ থাকবে এভাবে-
যোহবমন্যেত তে মূলে হেতুশাস্ত্রাশ্রয়াদ্ দ্বিজঃ।
স সাধুভি র্বহিষ্কার্যো নাস্তিকো বেদনিন্দকঃ।। ২ / ১১।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : যে দ্বিজ হেতুশাস্ত্র অর্থাৎ অসৎ-তর্ককে অবলম্বন ক’রে ধর্মের মূলস্বরূপ এই শাস্ত্রদ্বয়ের (শ্রুতি ও স্মৃতির) প্রাধান্য অস্বীকার করে (বা অনাদর করে), সাধু ব্যক্তিদের কর্তব্য হবে- তাকে সকল কর্তব্য কর্ম এবং সমাজ থেকে বহিষ্কৃত করা (অর্থাৎ অপাংক্তেয় ক’রে রাখা)। কারণ, সেই ব্যক্তি বেদের নিন্দাকারী, অতএব নাস্তিক।  

যুক্তিহীন ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার এই শাস্ত্রসম্মত প্রাচীন নজির একালেও বিরল তো নয়ই, বরং ভিন্ন রূপে ভিন্ন মোড়কে তাকে আরো বেশি মাত্রায় সক্রিয় হতে দেখা যায় এখনো। তৎকালীন ব্রাহ্মণ্যবাদের অন্তঃসারশূন্য শান্ত্র-দর্শনের বিপরীতে জড়বাদী লোকায়ত চার্বাক দর্শনের এইযে বাস্তববাদী শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড়িয়ে গেলো, তাকে প্রতিরোধ করতেই সে-সময়কার শাসকদের নিয়োজিত করতে হয়েছিলো তাদের সর্বময় শক্তি। তাদের দর্শনের প্রধান কাজই হয়ে দাঁড়ালো ওই লোকায়তের বাস্তব যুক্তি খণ্ডনের উপায় অন্বেষণ। আর এই শক্তির বলয় তৈরি করতে সৃষ্টি করতে হয়েছে সম্পূর্ণ এক পরভোজী সম্প্রদায়, উৎপাদন সংশ্লিষ্টতাহীন আরাম-আয়েশ-বিলাস-ব্যসনে মত্ত অঢেল সময় থেকে যাদের একমাত্র কাজ হলো নতুন নতুন ধর্মশাস্ত্রীয় কল্পনা, যুক্তি, তর্ক ইত্যাদির সমৃদ্ধিতে নিজেদের সার্বক্ষণিক নিয়োজিত রাখা। রাজশক্তির সম্পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের অঢেল ভোগলিপ্সা পরিতৃপ্তির পাশাপাশি এরা রচনা করবে রাজশক্তিকে নিরাপদ রাখার যাবতীয় কলাকৌশল। এরাই ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়, ক্ষত্রিয় শাসনে তাদেরকে দেয়া হলো সর্বোচ্চ সম্মানে অধিষ্ঠিত বিদ্যাগুরুর পদ। এরাই চর্চা করবে যাবতীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের, তৈরি করবে সামাজিক আইন, তাদের মুখনিঃসৃত বাণীই  হবে নীতিশাস্ত্র, সংবিধান, পালনীয় আচার। কারণ তাঁরাই জ্ঞানী বা বিদ্বান হিসেবে স্বীকৃত। তাঁদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও দায়িত্ব নির্দেশ করে মনুশাস্ত্রে তাই বলা হচ্ছে-
সর্বং তু সমবেক্ষ্যেদং নিখিলং জ্ঞানচক্ষুষা।
শ্রুতিপ্রামণ্যতো বিদ্বান্ স্বধর্মে নিবিশেত বৈ।। ২ / ৮।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : বিদ্বান্ ব্যক্তি সমস্ত বিষয়ে [যা কৃত্রিম অর্থাৎ উৎপত্তিযুক্ত এবং যা অকৃত্রিম অর্থাৎ উৎপত্তিবিহীন, যা প্রত্যক্ষ প্রমাণগম্য এবং যা অনুমানাদি প্রমাণগম্য- এই সমস্ত জ্ঞেয় পদার্থ] জ্ঞানরূপ চক্ষুর দ্বারা [অর্থাৎ তর্ক, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, মীমাংসা প্রভৃতি বিদ্যাবিষয় আচার্যের মুখ থেকে শুনে এবং নিজে তা চিন্তা করে যে জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তার দ্বারা] ভালোভাবে বিচারপূর্বক নিরূপণ করে বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করে নিজ ধর্মে নিবিষ্ট হবেন।
অতএব, বিদ্বানের তৎকালীন শাস্ত্রবিহিত সংজ্ঞাটা স্পষ্টভাবেই নির্দেশিত হয়ে গেছে। গুরু চাণক্য যে সেকালের সর্বশ্রেষ্ট বিদ্বান ছিলেন তা তাঁর জীবন চরিত থেকেই আমরা জানতে পারি। তিনি একাধারে শাস্ত্রজ্ঞ দার্শনিক, কূটনীতিজ্ঞ, জ্যোতির্বিদ, রতিশাস্ত্রবিদ, ন্যায়ভাষ্যকার, ভারতবর্ষের প্রথম সাম্রাজ্যবিস্তারকারী সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের উপদেষ্টা গুরু ও প্রধানমন্ত্রী অর্থাৎ রাজপুরুষও এবং আরো অনেককিছু। ফলে তাঁর রচিত নীতিশাস্ত্রে বর্ণিত নীতিশ্লোকের মাহাত্ম্য অনেক গভীরেই প্রোথিত আছে বলাবাহুল্য।
.
সমাজে বিদ্বানের পরিচয় আমরা ইতোমধ্যে পেয়ে গেলেও বিদ্যা বলতে প্রকৃতই কী বোঝানো হয়েছে তা মনুসংহিতার অবশ্যপালনীয় বিধান থেকে মোটামুটি একটা চিত্র আমরা পেয়ে যাই। তবু এ ব্যাপারে যাতে কোন অস্পষ্টতা না থাকে সেজন্যেই সাম্রাজ্য পরিচালনার যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে রাষ্ট্রনায়কদের পালনীয় নীতিকোষ হিসেবে কৌটিল্য ছদ্মনামে রচিত চাণক্যের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আকরগ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্রে’ প্রয়োজনীয় বিদ্যা বলতে কী বোঝায় তা তিনি স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন-
‘আন্বীক্ষিকী ত্রয়ী বার্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি বিদ্যাঃ। ১/২/১  (কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র)।
অর্থাৎ : আন্বীক্ষিকী, ত্রয়ী, বার্তা ও দণ্ডনীতি- এই চারটিই বিদ্যা।

ত্রয়ী অর্থ বেদ। ঋগে¦দ, সামবেদ, যজুর্বেদ এই তিনটি একত্রে বেদ। সেকালে তখনো চতুর্থ বেদ অর্থাৎ অথর্ববেদ সংগৃহীত হয়নি বা তখনো তা বেদ হিসেবে গুরুত্ববহ স্বীকৃতি পায়নি বলে প্রাচীন শাস্ত্রে বেদকে ত্রয়ী হিসেবেই উল্লেখ করা হয়। দণ্ডনীতি হলো রাজকার্য পরিচালনার বিধান। বার্তা হলো কৃষি ইত্যাদি অর্থনীতিসংক্রান্ত বিদ্যা। আর আন্বীক্ষিকী হলো তর্কবিদ্যা। এ সম্পর্কে অর্থশাস্ত্রেই বলা হচ্ছে-
‘প্রদীপঃ সর্ববিদ্যানামুপায়ঃ সর্বকর্মনাম্ ।
আশ্রয়ঃ সর্বধর্মানাং শশ্বদান্বীক্ষিকী মতা।। ১/২/১১।। (কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র)
অর্থাৎ : সব রকম বিদ্যার প্রদীপ, সব কাজের উপায় এবং সকল ধর্মের আশ্রয় হলো আন্বীক্ষিকী।

বুঝাই যাচ্ছে, প্রচলিত ধর্মকে রার করার উপায় হিসেবে সৃষ্ট ন্যায়শাস্ত্র, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, মীমাংসা ইত্যাদি ধর্মীয় শাস্ত্রকে হেতু বা যুক্তির মাধ্যমে ধর্ম-অধর্ম, অর্থ-অনর্থ, ফলাফল ইত্যাদির বিচার করে বেদের প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠা করাই আন্বীক্ষিকীর উদ্দেশ্য। আর এজন্যেই লোকায়ত বার্হষ্পত্যরা আন্বীক্ষিকীকে প্রামাণ্য বিদ্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেন না। আর ত্রয়ী বা বেদকে তো প্রামাণ্য মানতেই নারাজ। কারণ তাঁদের মতে-
‘তদপ্রামাণ্যমনৃত-ব্যাঘাত-পুনরুক্ত-দোষেভ্যঃ’। ৫৮। (বার্হস্পত্যসূত্র)
অর্থাৎ : এতে (বেদে) অনৃত দোষ বা মিথ্যে কথা, ব্যাঘাত দোষ বা পরস্পর বিরুদ্ধ কথা এবং পুনরুক্ত দোষ পূর্ণ।
.
‘ধূর্ত্ত-প্রলাপস্ত্রয়ী’। ৫৯। (বার্হস্পত্যসূত্র)
অর্থাৎ : (বেদের কর্তা) ভণ্ড, ধূর্ত, নিশাচর ত্রয়ী।

লোকায়তিকরা প্রত্যক্ষের বাইরে কোন কিছুকেই প্রমাণ হিসেবে মানেন না। তাই কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে বার্হস্পত্যদের সম্পর্কে উক্তি করেছেন-
‘বার্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি বার্হস্পত্যাঃ। ১/২/৪। (কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র)
অর্থাৎ : বার্হস্পত্যদের মতে বিদ্যা হলো দুটি- দণ্ডনীতি এবং বার্তা।

কৌটিল্য যে বার্হস্পত্যদের সাথে কোনভাবেই একমত নন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা তিনি তো বিদ্যা অর্থে চারটি শাস্ত্রকেই নির্দেশ করেছেন। অতএব, কৌটিল্য তথা চাণক্যের নীতিশ্লোকে বর্ণিত বিদ্বানের আয়ত্তে কোন্ কোন্ বিদ্যা থাকবে তা পরিষ্কার। সমাজকে তাঁদের চাওয়া অনুযায়ী এগিয়ে নেয়ার প্রয়োজনে যেসব শাস্ত্রে বুৎপত্তি, দক্ষতা ও লক্ষ্যনিষ্ঠ সক্রিয়তা থাকা দরকার মনে করেছেন, সেটাই নীতিশাস্ত্রের মাধ্যমে সমাজকে জানিয়ে দিয়েছেন। মোড়কের বাইরে বিদ্যা নাম নিয়ে কোন আপত্তি না-থাকলেও বিদ্যার সংজ্ঞা, কাঠামো, উৎস বা লক্ষ্য নিয়ে তৎকালীন দার্শনিক চিন্তকদের মধ্যে যে প্রচণ্ড অন্তর্বিরোধের সাংঘর্ষিক উপাদান সক্রিয় ছিলো তাও নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারছি আমরা। আর আজ থেকে আড়াই হাজার বছর পূর্বেকার সমাজ ও তার ভৌগোলিক অবস্থা, যোগাযোগ কাঠামো, জীবনধারণ পরিবেশ ইত্যকার বিষয় বিবেচনায় নিলে সে-সময় প্রবাস বলতে নিশ্চয়ই অত্যাধুনিক উড়োজাহাজে চড়ে সুদূর মার্কিনদেশ বা পাশ্চাত্যের ইউরোপ ভ্রমণ বোঝাতো না। খুব স্বাভাবিকভাবে আশেপাশের কোন গমনযোগ্য রাজ্য বা অঞ্চল কিংবা তৎকালীন বৃহত্তর ভারতবর্ষকেই বোঝানো হতো। ফলে বিদ্বান সর্বত্র পূজনীয় বলা হলেও এই সর্বত্রেরও যে একটা সীমিত ভৌগলিক কাঠামো ছিলো তাও বোঝার বাকি থাকে না। ওই কাঠামোর মধ্যে বাস্তবায়ন যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যবহারিক মূল্যের আলোকেই বিদ্যাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ঠিক এই বিষয়টিকে মাথায় রাখলেই আমরা নীতিশাস্ত্রের সেই চিরায়ত সুরের খোঁজটি পেয়ে যাই। যেখানে প্রয়োজনীয় সমকালীন তান সংযুক্ত করে দিলেই তা যুগোপযোগী হয়ে ওঠতে পারে। আর তাই এই নীতিকথাকে আমরা পরিত্যাগ করতে পারি না তো বটেই, বরং সময়ের তরতাজা ক্রমানুক্রমিক রসে সিক্ত হয়ে তা আমাদের জন্য কালোত্তীর্ণ এক চিরকালীন অমূল্য রত্ন হিসেবেই আগ্রহের বিষয়বস্তু হয়ে থাকে।
.
এবার তাহলে আমরা ফিরে যাই নীতিশ্লোকটির কাছে। কোন রাজাধিরাজ নয়, বিদ্বানই সর্বত্র পূজিত হন। কারণ তিনিই বিদ্বান্ যিনি সেই বিদ্যাটিই আয়ত্ত করেন যা দিয়ে সমাজ-সভ্যতার অগ্রযাত্রা আরো বেগবান, সৃষ্টিশীল ও বহুমাত্রিক হয়ে ওঠে। আর যা আঁকড়ে থাকলে সমাজ স্থবিরতায় আক্রান্ত হয়, সম্মুখগতি হারিয়ে পেছনমুখি হয় সেটা কোন বিদ্যাই নয়। তাই ওইসব প্রাগৈতিহাসিক জঞ্জালবিদ্যায় পাণ্ডিত্যের পাহাড় জমিয়ে তাকে রিসাইক্লিং না করে কেবলি ঘাটাঘুটি করলে পচা-গলা-বাসি অস্বাস্থ্যকর দুর্গন্ধই ছড়াবে শুধু, সমাজ আক্রান্ত হবে অথর্বতায়, কিন্তু কোন বিদ্যা বা বিদ্বান বেরুবে না যিনি মানুষকে সামনে যাবার পথটা দেখিয়ে দেবেন। সর্বত্র পূজিত বিদ্বান তিনিই যিনি যে-সমাজের অধিবাসীই হোন না কেন বৃহত্তর মানবসমাজকে সামনে এগিয়ে যাবার পথটা তৈরি করে দেন তার সমকালীন বিদ্যার সৃষ্টিশীলতা দিয়ে। দেশ-কাল অতিক্রম করে মানবসভ্যতা যাদের কাছে ঋণী, সভ্যতার প্রারম্ভিক কাল থেকে একাল পর্যন্ত  এরকম বহু বহু বিদ্বানের নাম যুগে যুগে মানবেতিহাসের অত্যুজ্জ্বল পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হয়ে আছে। কিন্তু এরা কেউ ধর্মপ্রচারক ছিলেন না। ধর্মের কূপমণ্ডূকতায় আবদ্ধও ছিলেন না এরা।
.
এসব নীতিশ্লোককে কেন্দ্র করে যুগে যুগে অনুসন্ধিৎসু জ্ঞানপিপাসুরা হয়েছেন প্রাণিত, বহু কবি তাঁদের সৃষ্টিকর্মকে করেছেন উজ্জ্বল। সাহিত্যে কাব্যে উপকথায় পল্লবিত হয়েছে অপরূপ বর্ণচ্ছটায়। আড়াই হাজার বছর পেরিয়ে আমরাও এখনো স্মরণ করছি এসব। এবং এ থেকেই এসব নীতিশ্লোকের অন্তর্নিহিত শক্তি ও সুদূরপ্রসারি প্রভাবটুকু অনুধাবন করা যায় সহজেই। চাণক্যের এই নীতিশ্লোক রচনার প্রায় তিনশ বছর পরের খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের আরেক সংস্কৃত কবিশ্রেষ্ঠ ভর্তৃহরির নীতিকাব্যেও দেখি তাই চাণক্যেজনের ছায়া-
বিদ্যা নাম নরস্য রূপমধিকং প্রচ্ছন্নগুপ্তং ধনং
বিদ্যা ভোগকরী যশঃসুখকরী বিদ্যা গুরূণাং গুরুঃ।
বিদ্যা বন্ধুজনো বিদেশগমনে বিদ্য পরা দেবতা
বিদ্যা রাজসু পূজিতা ন তু ধনং বিদ্যাবিহীনঃ পশুঃ।। ২০।। (ভর্তৃহরির নীতিশতক)।
অর্থাৎ : বিদ্যা মানুষের শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য ও গোপনে রক্ষিত (বহুমূল্য) ধন। বিদ্যা (মানুষকে) ভোগ দেয়, দেয় সুখ ও সুখ্যাতি। বিদ্যা গুরুর(-ও) গুরু। প্রবাসে বিদ্যা(-ই) বন্ধু। বিদ্যা পরম দেবতা। রাজসভায় বিদ্যা(-ই) সমাদৃত হয়, ধন নয়। (তাই) বিদ্যা যার নেই সে পশু(তুল্য)।
..
(পোস্টের ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত)

(চলবে…)

[ চাণক্যপর্ব ] [ * ] [ নীতিকথা-০২ ]

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

রণদীপম বসু


‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভাল।...’
.
.
.
(C) Ranadipam Basu

Blog Stats

  • 1,235,107 hits

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 188 other subscribers
Follow h-o-r-o-p-p-a-হ-র-প্পা on WordPress.com

কৃতকর্ম

সিঁড়িঘর

দিনপঞ্জি

মার্চ 2012
রবি সোম বুধ বৃহ. শু. শনি
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031

Bangladesh Genocide

1971 Bangladesh Genocide Archive

War Crimes Strategy Forum

লাইভ ট্রাফিক

ক’জন দেখছেন ?

হরপ্পা কাউন্টার

Add to Technorati Favorites

গুগল-সূচক

Protected by Copyscape Web Plagiarism Check

Flickr Photos