শিব ও লিঙ্গ-০৯/৭ : বীরশৈব বা লিঙ্গায়ৎ সম্প্রদায়
Posted 04/09/2018
on:
শিব ও লিঙ্গ-০৯/৭ : বীরশৈব বা লিঙ্গায়ৎ সম্প্রদায়
রণদীপম বসু
…
মধ্যযুগে দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক অঞ্চলে অনেকটা জঙ্গী ধরনের একটি শৈব সম্প্রদায় গড়ে ওঠে, যার নাম বীরশৈব বা লিঙ্গায়ৎ। এদেরকে লিঙ্গবন্ত ও জঙ্গম নামেও অভিহিত করা হয়। ভারতীয় সুপ্রাচীন কোন গ্রন্থে বা শৈবাগম শাস্ত্রে এই লিঙ্গায়ৎ ধর্ম ও সম্প্রদায়ের কোন উল্লেখ না থাকলেও এটি অনেক পুরাতন যুগের ঐতিহ্যবাহী বলে মনে করা হয়, যে ঐতিহ্যকে একটি সুনির্দিষ্ট রূপ দিয়েছিলেন বসব বা বাসব নামক একজন কন্নড় দেশীয় ব্রাহ্মণ। তাঁর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল কর্ণাটক থেকে জৈনদের উৎখাত করা, এবং দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল একটি আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা স্থাপন। দুটি উদ্দেশ্যই বহুলাংশে সিদ্ধ হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
বীরশৈবরা নারী পুরুষ নির্বিশেষে শরীরে শিবলিঙ্গ ধারণ করেন। এই প্রথার সর্বপ্রাচীন ইঙ্গিত পাওয়া যায় খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের সুতসংহিতা নামক গ্রন্থে। প্রাক্-গুপ্ত কালের উত্তর ভারতীয় ভারশিব রাজবংশের রাজারা, যাঁরা মথুরা, পদ্মাবতী, চম্পাবতী প্রভৃতি অঞ্চলে রাজত্ব করতেন, মস্তকে শিবলিঙ্গ ধারণ করতেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিমত হলো–
‘…এই শৈবগোষ্ঠীর উদ্ভব ঠিক কোন সময়ে হইয়াছিল সে বিষয়ে মতভেদ আছে; তবে সুগঠিত সম্প্রদায় হিসাবে ইহা যে অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। মাধবাচার্য (খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর) তাঁহার সর্বদর্শনসংগ্রহে পাশুপত (নকুলীশ পাশুপত) ও আগমান্ত শৈবদিগের বর্ণনা করিয়াছেন, কিন্তু বীরশৈবদিগের কোনও উল্লেখ করেন নাই। শঙ্করাচার্য, বাচস্পতি এবং শঙ্করদিগ্বিজয়প্রণেতা আনন্দগিরি ইঁহাদের বিষয়ে কিছু বলেন নাই। শৈবাগম শাস্ত্রে এ সম্বন্ধে কিছু লিখিত নাই, যদিও বাতুলতন্ত্র বা বাতুলাগম নামক ঈশানবক্ত্রনিঃসৃত এক অপ্রকাশিত শৈবাগমের একটি পুঁথির পরিশিষ্ট অংশে বীরশৈবদিগের অন্যতম ধর্মতত্ত্ব ষট্স্থলের কথা বলা হইয়াছে। তবে ইহার উল্লেখ গ্রন্থের পরিশিষ্টভাগে থাকার জন্য অনুমান হয় যে ইহা প্রক্ষিপ্ত। ইঁহাদের লিঙ্গধারণ নামক আর এক ধর্মাচরণ সম্বন্ধে দক্ষিণ ভারতের কোনও সুপ্রাচীন গ্রন্থে কিছু লিপিবদ্ধ নাই, এবং এ সত্যও ইঁহাদিগকে অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালে স্থাপন করিবার মতের পক্ষে অনুকূল। কিন্তু ইঁহাদিগের কোনও কোনও ধর্মতত্ত্বের অনুরূপ তত্ত্ব বহু পূর্ববর্তী যুগের দুএকটি গ্রন্থে ব্যাখ্যাত হইয়াছিল, উহা ষষ্ঠ শতাব্দীতে রচিত সুতসংহিতা নামক গ্রন্থপাঠে জানা যায়। শরীরে শিবলিঙ্গ ধারণ লিঙ্গায়ৎদিগের একটি অবশ্যকরণীয় ধর্মাচরণ। ইহার প্রাচীনতম প্রয়োগ প্রাক্গুপ্তকালের উত্তর ভারতীয় ভারশিব নাগ-বংশের রাজাদিগের (ইঁহারা মথুরা, পদ্মাবতী, চম্পাবতী প্রভৃতি স্থানে রাজত্ব করিতেন) এক ধর্মপ্রথা হইতে আমরা জানিতে পারি। ইঁহারা শৈব ছিলেন, এবং শরীরে (মস্তকে) শিবলিঙ্গ ধারণ বা বহন করিতেন। এই প্রথা হইতেই মনে হয় তাঁহারা ভারশিব নামে পরিচিত হইয়াছিলেন। কিন্তু পূর্বকালের অনুরূপ তত্ত্ব ও ধর্মাচরণ যে লিঙ্গায়ৎদিগের ধর্মতত্ত্ব ও অনুষ্ঠান প্রভাবিত করিয়াছিল ইহা অনুমান করা যুক্তিসঙ্গত না হইতে পারে।’– (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-২০৪-২০৫)
বীরশৈব সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান পুরুষ ছিলেন বসব। লিঙ্গায়ৎ-দের প্রামাণিক শাস্ত্র বসবপুরাণে তিনি শিবের বাহন নন্দীর অবতার বলে বর্ণিত হয়েছেন। এখানে উল্লেখ্য, ‘বসব’ হচ্ছে সংস্কৃত ‘বৃষভ’ শব্দটির কানাড়ী প্রতিরূপ। অজ্ঞাত রচনাকার কর্তৃক ত্রয়োদশ শতকে রচিত এই বসবপুরাণ থেকে জানা যায়, বসব ছিলেন বাগেবাড়ির অধিবাসী কানাড়ী ব্রাহ্মণ, এবং তাঁর পিতার নাম ছিল মাদিরাজ। প্রথম যৌবনে তিনি বোম্বাই-এর নিকটবর্তী কল্যাণের চালুক্যরাজ বিজ্জল বা বিজ্জণ রায়ের মন্ত্রী ছিলেন। বিজ্জল ১১৫৭ থেকে ১১৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। রাজা ছিলেন জৈনধর্মাবলম্বী। শাসনকার্যে বসবের সঙ্গে রাজার মতভেদ হয়, এবং তাঁর প্ররোচনায় বিজ্জল নিহত হন। বসব তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতা ও পদমর্যাদার সুযোগে বীরশৈব সম্প্রদায়কে সুসংহত করেন।
‘১১৬০ খ্রীষ্টাব্দে বসব শিবানুভব-মণ্ডপ নামক একটি সংস্থার সৃষ্টি করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল ক্ষয়িষ্ণু ধর্মে নতুন প্রাণ-সঞ্চার করা, স্ত্রী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা, জাতিভেদ-প্রথার বিলোপ, বাণিজ্য ও কায়িক শ্রমে উৎসাহ প্রদর্শন। শ্রীকুমারস্বামীজী যথার্থই বলেছেন : “বসবের কর্মক্ষেত্র যেমনই বৈচিত্র্যপূর্ণ তেমনি বিশাল ছিল, এবং এই প্রতিষ্ঠান তাঁর প্রতিভার একটি বিশেষ প্রমাণ। এটা যে কেবলমাত্র তাঁর ব্যবহারিক বিজ্ঞতার পরিচয় দেয় তাই-ই নয়, তাঁর মধ্যে যে বুদ্ধি, হৃদয়াবেগ ও কর্মদক্ষতার সমন্বয় হয়েছিল তারও পরিচয় দেয়। কারণ তিনিই শৈবধর্মকে বর্ণাশ্রমের শৃংখল থেকে মুক্ত করেছিলেন, এবং তাতে একটি নূতন দৃষ্টিভঙ্গী এনেছিলেন।’– (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-২১০)
ঠিক কোন্ সময়ে এই বীরশৈব সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয় তা নিশ্চয় করে কিছু বলা না গেলেও অনুমান করা হয় যে তা বসবের আবির্ভাবকালের খুব বেশি পূর্ববর্তী ছিল না। লিঙ্গায়ৎদের শ্রেষ্ঠ পর্যায়ের ব্যক্তিরা লিঙ্গী ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত হতেন, অন্য লিঙ্গায়ৎগণ ছিলেন তাঁদের অনুচর। অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষ্যে–
‘লিঙ্গী ব্রাহ্মণদিগের দুইটি বিভাগ– আচার্য ও পঞ্চম। পূর্বে যে বিশ্বারাধ্য ইত্যাদি পাঁচজন [আদি] আচার্যের কথা বলা হইয়াছে, [বিশ্বারাধ্য, রেবণসিদ্ধ, মরুলসিদ্ধ, একোরাম এবং পণ্ডিতারাধ্য] তাঁহারাই ছিলেন আচার্য লিঙ্গী ব্রাহ্মণদিগের পূর্বপুরুষ; আচার্য লিঙ্গী ব্রাহ্মণেরাই সম্প্রদায়ের পৌরোহিত্য ইত্যাদি করিতেন। ইঁহারা মহাদেবের পাঁচটি বক্ত্র হইতে আবির্ভূত হইয়াছিলেন বলিয়া ইঁহাদের বিশ্বাস, এবং তাঁহারা বীর, নন্দী, বৃষভ, ভৃঙ্গী ও স্কন্দ নামক পাঁচটি গোত্রে বিভক্ত ছিলেন। পঞ্চমদিগের উৎপত্তি সম্বন্ধে কিংবদন্তী এই যে শিবের ঈশানবক্ত্র হইতে একটি পঞ্চবক্ত্র গণেশ্বরের উদ্ভব হয়; এই পণেশ্বরের পাঁচটি মুখ হইতে মখারি, কালারি, পুরারি, স্মরারি এবং বেদারি নামক পাঁচজন পঞ্চমের উৎপত্তি হইয়াছিল। উপপঞ্চম নামে এক শ্রেণীর লিঙ্গায়ৎ পঞ্চম হইতে উদ্ভূত হইয়াছিলেন। প্রত্যেক পঞ্চমের এক একজন আচার্য লিঙ্গী ব্রাহ্মণের সহিত গুরু-শিষ্য সম্বন্ধ বর্তমান ছিল, এবং গুরুর গোত্রই ইঁহার গোত্র বলিয়া স্বীকৃত হইত। গোত্র ব্যতীত পঞ্চমদিগের নিজ নিজ প্রবর, শাখা ইত্যাদি ছিল। অপর এক বিবরণ অনুযায়ী লিঙ্গায়ৎগণ জঙ্গম, শীলবন্ত, বনজিগ ও পঞ্চমশালী নামক চারিভাগে বিভক্ত ছিলেন, প্রথম বিভাগের লিঙ্গায়ৎগণ ইঁহাদের মধ্যে উচ্চতম পর্যায়ভুক্ত ছিলেন এবং সমাজে পৌরোহিত্য ইত্যাদি কার্যের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন; সুতরাং পূর্বোক্ত আচার্য লিঙ্গী ব্রাহ্মণ এবং জঙ্গম একই শ্রেণীর লিঙ্গায়ৎকে বুঝাইত। শীলাবন্ত অর্থাৎ সদাচারপরায়ণ লিঙ্গায়ৎগণের সামাজিক মর্যাদা প্রথম শ্রেণীর অপেক্ষা অধিক নিম্নপর্যায়ের ছিল না। বনজিগগণ বাণিজ্যাদি ব্যাপারে লিপ্ত থাকিতেন, এবং পঞ্চমশালী সাধারণতঃ জঙ্গম ও শীলাবন্তাদির অনুচর হইতেন। জঙ্গমদিগের মধ্যেও দুইটি শ্রেণী ছিল। প্রথম শ্রেণীর জঙ্গমগণ ‘বিরক্ত’ নামে অভিহিত হইতেন; ইঁহারা বিবাহ করিতেন না এবং ধ্যান, ধারণা, তপশ্চর্যা ইত্যাদি ধর্মাচরণে ব্যাপৃত থাকিতেন। ইঁহারা মঠাধীশ হইতেন এবং সকলের অতীব ভক্তি শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। ইঁহারা পরিব্রাজক রূপে বিচিত্র বেশ পরিধান করিয়া ভারতবর্ষের পঞ্চ শৈবতীর্থে পরিভ্রমণ করিয়া বেড়াইতেন। এগুলি কড়ুর, উজ্জয়িনী, বারাণসী, শ্রীশৈল ও কেদারনাথ। বীর শৈবদিগের নিকট ইহারা সিংহাসন নামে পরিচিত। দ্বিতীয় শ্রেণীর জঙ্গমেরা বিবাহাদি করিয়া গৃহী হইতেন এবং পৌরোহিত্য ইত্যাদির কার্য ইঁহারাই করিতেন।’– (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-২০৮-১০)
এছাড়া লিঙ্গায়ৎদের মধ্যে ব্রাহ্মণদের মতো প্রচলিত উপনয়ন সংস্কারের ন্যায় একপ্রকার দীক্ষানুষ্ঠানের প্রচলন রয়েছে। এর নাম লিঙ্গ-স্বায়ত্ত-দীক্ষা। এ অনুষ্ঠানে তাঁরা উপবীত ধারণ করেন না, ব্রাহ্মণ্য গায়ত্রীমন্ত্র পাঠ করেন না। তাঁদের গায়ত্রীমন্ত্র হলো পবিত্র পঞ্চাক্ষর শৈবমন্ত্র, নমঃ শিবায় অথবা ওঁ নমঃ শিবায়, এবং তাঁরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যজ্ঞোপবীতের পরিবর্তে কণ্ঠে ইষ্টলিঙ্গ নামে পরিচিত ক্ষুদ্র শিবলিঙ্গ ধারণ করেন। শরীরে ধারণকৃত ইষ্টলিঙ্গের নিয়মিত পূজা ও আহ্নিক তাঁদের নিত্য কর্তব্য বলে গণ্য হয়। বীরশৈবেরা ইষ্টলিঙ্গ ব্যতীত অন্য কোন দেবমূর্তির পূজা করেন না, তবে শিবের সম্পর্কিত দেবতারা তাঁদের কাছে সম্মান পান। বেদ সম্পর্কে বীরশৈবেরা ঔদাসীন্যের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা বেদবিরোধিতা করেননি, কিন্তু বেদপ্রামাণ্যও স্বীকার করেননি। রামকৃষ্ণ গোপাল ভান্ডারকর প্রমুখের মতে বীরশৈবদের দ্বারা বহু সামাজিক সংস্কার সাধিত হয়েছিল। অধ্যাপক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ভাষ্যে–
‘সমাজ-সংস্কারের দিকে তাঁদের বিশেষ ঝোঁক ছিল, এবং দরিদ্রশ্রেণীর অবস্থার উন্নতির দিকে তাঁদের নজর ছিল। জৈনদের অনুকরণে তাঁরা অন্ন দান, জল দান, ঔষধ দান ও বিদ্যা দানকে সম্প্রদায়ভুক্তদের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য হিসাবে নির্দিষ্ট করেছিলেন। বীরশৈবেরা জাতিভেদ মানেন না। তাঁরা ধূমপান, মদ্যপান ও মাংস ভক্ষণের বিরোধী। বীরশৈব সমাজের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য নারীর স্থান। তাঁদের সমাজ বাল্যবিবাহ বিরোধী এবং যা সবচেয়ে বড় কথা, তাঁরা বিধবা বিবাহের সমর্থক। এই সকল দিক থেকে দেখলে এই সম্প্রদায়ের প্রধান প্রবক্তা আচার্য বসব শুধু অসাধারণই নন, অনন্যসাধারণ।’– (ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-২০৯)
বসব ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের দিক দিয়ে বিশেষ কিছু না করলেও বীরশৈব সম্প্রদায়ের সামাজিক প্রতিষ্ঠা বর্ধনে নিশ্চিতভাবেই কৃতকার্যতা লাভ করেন। মহাশয় অক্ষয় কুমার দত্তের ভাষ্যে–
‘বাসব হিন্দু ধর্মের অন্তর্গত অনেকানেক বিষয় নিতান্ত ভ্রান্তিমূলক জানিয়া একবারে পরিত্যাগ করেন। সূর্য, অগ্নি ও অন্য অন্য দেব-দেবীর পূজা, জাতিভেদ, মরণোত্তর যোনি ভ্রমণ, ব্রাহ্মণেরা ব্রহ্ম সন্তান ও শুদ্ধাত্মা এই দুইটি কথা, অভিসম্পাতের আশঙ্কা, প্রায়শ্চিত্ত, তীর্থ-ভ্রমণ, স্থান-বিশেষের মাহাত্ম্য, স্ত্রীলোকের অপ্রাধান্য ও অপদস্থতা, নিকট-সম্পর্কীয় কন্যার পাণিগ্রহণ, প্রতিষেধ, গঙ্গাদি তীর্থ-জল সেবন, ব্রাহ্মণ ভোজন ও উপবাস, শৌচাশৌচ সুলক্ষণ, কুলক্ষণ, অন্ত্যেষ্টি-ক্রিয়ার অত্যাবশ্যকতা এ সমস্তই তিনি ভ্রমাত্মক বলিয়া অগ্রাহ্য করেন।’
‘বাসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লিঙ্গ-মূর্তি প্রস্তুত করিয়া স্ত্রী-পুরুষ উভয় জাতীয় শিষ্যগণের হস্তে ও গল-দেশে ধারণ করিতে উপদেশ দেন। তাঁহার মতে, গুরু, লিঙ্গ, জঙ্গম (স্ব সম্প্রদায়ী লোক) এই তিনটি মাত্র পরমেশ্বর-কৃত পবিত্র পদার্থ। ঐ লিঙ্গ ব্যতিরেকে ইহারা বিভূতি ও রুদ্রাক্ষ এই দুইটি শৈব-চিহ্নও ব্যবহার করিয়া থাকে।’
‘এই সম্প্রদায়ের মধ্যে স্ত্রী-পুরুষ উভয় জাতিরই গুরুত্ব-পদ গ্রহণের অধিকার আছে। দীক্ষাকালে গুরু শিষ্যের কর্ণকুহরে মন্ত্রোপদেশ করেন এবং তাহার গলদেশে কিম্বা হস্তে লিঙ্গ-মূর্তি বান্ধিয়া দেন। গুরুর পক্ষে মদ্য মাংস ও তাম্বুল ব্যবহার নিষিদ্ধ।’– (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় [দ্বিতীয় ভাগ], পৃষ্ঠা-৯৮-৯৯)
বসব নিজে সম্প্রদায় সংক্রান্ত কোন উল্লেখযোগ্য শাস্ত্রগ্রন্থ প্রণয়ন করেননি বটে, কিন্তু তাঁর নামে কানাড়ী ভাষায় রচিত বহু উক্তি ও প্রবচন প্রচলিত আছে। এগুলি তাঁর অপরিসীম শিবভক্তির পরিচায়ক। তিনি ভগবান শিবকে পরম ব্রহ্ম এবং নিজেকে তাঁর দীন সেবক বলে পরিচিত করেছেন। এই বচনগুলি কন্নড় সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ। প্রসঙ্গত, বীবশৈবদের পবিত্রতম ও প্রামাণিক শাস্ত্র কন্নড় ভাষায় রচিত বসবপুরাণ (ত্রয়োদশ শতক) এবং ষোড়শ শতকের শেষপাদে আচার্য বিরূপাক্ষী কর্তৃক রচিত ছন্নবসবপুরাণ (ছন্নবসব বসবাচার্যের জ্যেষ্ঠা ভগিনীর গর্ভে শিবের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে কিংবদন্তী)।
বীরশৈবদের ধর্মদর্শনের মূলতত্ত্বগুলির কিয়দংশ স্কন্দপুরাণের অন্তর্গত সুতসংহিতা, কামিকাগম প্রভৃতি অপেক্ষাকৃত প্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থে পাওয়া যায়। কিন্তু বিশদ ও সুবিন্যস্তভাবে তা পাওয়া যায় সংস্কৃতে মগ্গেয় ময়িদেব রচিত শিবানুভবসূত্র, মতিরতন্তাদার্যের বীরশৈবাণ্ডচন্দ্রিকা, রেণুকাচার্য রচিত সিদ্ধান্তশিখামণি এবং কন্নড় ভাষায় রচিত প্রভুলিঙ্গলীলা প্রভৃতি প্রামাণ্য গ্রন্থে। বীরশৈবধর্মের মূল কথা হলো–
সর্বেষাং স্থান ভূতত্বাল লয় ভূতত্ত্বতস্তথা।
তত্ত্বানাং মহদাদিনাং স্থলমিত্যভিধীয়তে।। (শিবানুভবসূত্র-২)
অর্থাৎ, দৃশ্যমান জগতের যিনি আদি কারণ ও আধার এবং সমস্ত জাগতিক ক্রমবিকাশের মূল ও চরম গতি, তিনি হলেন স্থল। স্থ অর্থ স্থিতি যাতে বিশ্বজগতের কারণ স্থিত, ল অর্থ লীন যাতে সৃষ্ট বিশ্বচরাচর প্রলয়কালে লীন হয়ে যায়।
সৎ চিৎ ও আনন্দ স্বরূপ এক এবং অদ্বিতীয় পরম ব্রহ্মই শিবতত্ত্ব নামে পরিচিত। তাঁর আরেক নাম স্থল; যাঁর মধ্যে মহৎ আদি বিশ্বপ্রপঞ্চের কারণবীজ প্রতিষ্ঠিত এবং প্রলয়কালে প্রকৃতি ও পুরুষ থেকে সঞ্জাত বিশ্বচরাচর সমস্তই তাঁর মধ্যে প্রত্যাবর্তন করে লীন হয়, এ কারণেই তাঁর এই নাম (স্থ + ল)। অন্তর্নিহিত শক্তির আলোড়নের ফলে এই স্থল লিঙ্গস্থল ও অঙ্গস্থল নামক দুই অংশে বিভক্ত হন। লিঙ্গস্থলই উপাস্য রুদ্র-শিব, পরমাত্মা এবং অঙ্গস্থল উপাসক জীব বা জীবাত্মা।
আবার লিঙ্গ শব্দটির ধাতুগত অর্থ লী ধাতু (দ্রবীভূত হওয়া) এবং গম্ ধাতু (যাওয়া), যা সেই চরম তত্ত্বকেই নির্দেশ করে যাতে সকল কিছুই লয়প্রাপ্ত হয়, আবার যা হতে সকলই উদ্ভূত হয়। লিঙ্গস্থল অর্থাৎ শিবের অন্তরস্থ শক্তিও আবার নিজ ইচ্ছাবশে দুই ভাগে বিভক্ত হন;– এক ভাগের নাম কলা, যা শিবকে আশ্রয় করে, এবং অপর ভাগের নাম ভক্তি, তা জীবকে অবলম্বনকারী ও জীবের মোক্ষ আনয়নকারী ক্রিয়াবিশেষ। ভক্তিপ্রয়োগের দ্বারাই লিঙ্গস্থল বা শিব ও অঙ্গস্থল বা জীবের মধ্যে যোগ স্থাপিত হয়।
লিঙ্গস্থলের অন্য তিন বিভাগের নাম– ভাবলিঙ্গ, প্রাণলিঙ্গ এবং ইষ্টলিঙ্গ;– এই বিভাগ তিনটি যথাক্রমে নিষ্কল, সকল-নিষ্কল ও স-কল নামেও পরিচিত। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষ্য হলো–
‘ভাবলিঙ্গ পরমব্রহ্মাত্মক শিবের সৎ, প্রাণলিঙ্গ চিৎ ও ইষ্টলিঙ্গ আনন্দ রূপের প্রকাশ; আবার অন্যদিকে ভাবলিঙ্গাত্মক সৎই সর্বশ্রেষ্ঠ তত্ত্ব, প্রাণলিঙ্গ উহার সূক্ষ্ম রূপ এবং ইষ্টলিঙ্গ জড় রূপের অভিব্যক্তি। এই লিঙ্গত্রয় প্রয়োগ, মন্ত্র ও ক্রিয়া গুণান্বিত হইয়া যথাক্রমে কলা, নাদ এবং বিন্দুতে পরিণত হয়। এই তিন তত্ত্বের প্রতিটি আবার দুই দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া মহালিঙ্গ বা মহাত্মলিঙ্গ, প্রসাদলিঙ্গ বা প্রসাদঘনলিঙ্গ, চরলিঙ্গ, শিবলিঙ্গ, গুরুলিঙ্গ এবং আচারলিঙ্গের রূপ পরিগ্রহ করে। এই ছয়টি লিঙ্গের আর এক নাম ষট্স্থল। ষড়বিধ লিঙ্গ ছয় শক্তির দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়াই বিভিন্ন রূপ প্রাপ্ত হয়। শক্তিগুলির নাম যথাক্রমে চিৎশক্তি, পরাশক্তি, আদিশক্তি, ইচ্ছাশক্তি, জ্ঞানশক্তি এবং ক্রিয়াশক্তি।’– (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-২১২-১৩)
অন্যদিকে, অঙ্গস্থলের ছয় বিভাগও ষট্স্থল নামে পরিচিত। মহামহোপাধ্যায় সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের মতে, আত্মন, আকাশ, বায়ু, অগ্নি, অপ্ ও ক্ষিতি একত্রে ষট্স্থল বলে অভিহিত; আত্মন থেকে আকাশ, আকাশ থেকে বায়ু, বায়ু থেকে অগ্নি, অগ্নি থেকে অপ্ এবং অপ্ থেকে ক্ষিতির উৎপত্তি। অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন যে, ষট্স্থল সম্বন্ধে তথ্য কোনও সংস্কৃত গ্রন্থে পাওয়া যায় না। কানাড়ী ভাষায় রচিত প্রভুলিঙ্গলীলা এবং বসবপুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে এ সম্বন্ধে জানা যায়। প্রভুলিঙ্গলীলা থেকে জানা যায় যে বসবের গুরু অল্লম তাঁর শিষ্যকে ষট্স্থল বিদ্যা শিখিয়েছিলেন। ছন্নবসবও এ বিদ্যায় দীক্ষিত হয়েছিলেন।
পরম শিবেরই আর এক রূপ অঙ্গস্থল বা জীবের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ভক্তি। অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথের ভাষ্যে– ‘জীবকে আশ্রয়কারী ভক্তির তিন পর্যায় বা ক্রমের নাম যোগাঙ্গ, ভোগাঙ্গ ও ত্যাগাঙ্গ। প্রথম পর্যায়ে জীব শিবের সহিত মিলিত হইয়া পরম সুখের অধিকারী হয়, দ্বিতীয়টিতে সে শিবসাযুজ্য ভোগ করে, এবং তৃতীয় পর্যায়ে জীব অনিত্য ও মায়াময় বোধে জগৎকে ত্যাগ করিতে সমর্থ হয়। যোগাঙ্গ জীবের ভক্তির দুই বিভাগ,– ঐক্য ও শরণ। জগৎ অনিত্য ভাবিয়া জীব যখন শিবের সহিত একাত্মীভূত হইয়া পরমানন্দরসে নিমগ্ন হয়, তখনই সে ঐক্যভক্তির অধিকারী হয়। ঐক্যভক্তি সমরসা ভক্তি নামেও অভিহিত। শরণভক্তি-বশে জীব শিবকে নিজের মধ্যে এবং সর্বত্র অবস্থিত বলিয়া উপলব্ধি করে; এই উপলব্ধির ফলও গভীর আনন্দবোধ। শরণভক্তিসম্পন্ন জীব প্রাণলিঙ্গিন এবং প্রসাদিন নামক দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগের জীব অহংজ্ঞান পরিত্যাগ করিয়া জীবন ধারণ সম্বন্ধে উদাসীন হইয়া তাহার সমস্ত চিত্ত ঈশ্বরে সমর্পণ করে। দ্বিতীয় প্রকার জীব উহার সমস্ত ভোগ্য বস্তু ঈশ্বরে সমর্পণ করিয়া প্রসাদ শান্তি লাভ করে। শেষোক্ত জীবের আবার মাহেশ্বর এবং ভক্ত নামে দুই বিভাগ বর্তমান। ঈশ্বরের অস্তিত্বে দৃঢ়বিশ্বাসী মাহেশ্বর নিজের জীবনকে ব্রত, নিয়ম সংযমাদির দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত করে, এবং জীবনে সত্য, নীতি ও শৌচাদির পথ হইতে ভ্রষ্ট হয় না। ভক্ত জীব সর্ব পার্থিব বিষয়ে অনাসক্তচিত্ত হইয়া নিত্যনৈমিত্তিক ধর্মানুষ্ঠান পালন করিয়া বৈরাগ্য ও ঔদাসীন্যপূর্ণ জীবন যাপন করে।’– (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-২১৪)
পরিশেষে বলা যায়, বীরশৈব তত্ত্বচিন্তায় সমস্ত সদ্বস্তুর মধ্যে উপাদান অপেক্ষা আকারের গুরুত্ব অধিক। উপাদানগত অংশ শক্তি। বীরশৈব মতে একটি আদি সত্তাই তার নিজস্ব শক্তির ক্রিয়ায় পরমাত্মা ও জীবাত্মায়, ঈশ্বরে ও জীবে রূপান্তরিত হন। এক্ষেত্রে দর্শনগত দৃষ্টিতে দেখা যায় যে,– ‘বীরশৈব মতবাদ মায়াবাদ স্বীকার করে না, কেননা জগৎ চৈতন্যের মিথ্যা বিবর্তন হতে পারে না। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের সঙ্গে এই মতবাদের মৌল পার্থক্য বিদ্যমান। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদে জীব ও জগতের সূক্ষ্ম উপাদান ঈশ্বরের বিশেষ গুণরূপে সৃষ্টির পূর্ব পর্যন্ত তাঁতেই বিদ্যমান এবং পরে সৃষ্টির প্রারম্ভে তাঁর থেকেই বিকাশমান। কিন্তু বীরশৈব মতে ঈশ্বরের এক বিশেষ শক্তি ও তাঁর বিভিন্ন ক্রম হতেই জীব ও জগতের উদ্ভব হয়।’– (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-২১০)
…
(চলমান…)
…
[পূর্বের পোস্ট : শুদ্ধশৈব বা শিবাদ্বৈত সম্প্রদায়] [*] [পরের পোস্ট : কাশ্মীর শৈববাদ]
…
মন্তব্য করুন