শিব ও লিঙ্গ-০৯/৪ : শৈব সিদ্ধান্ত বা তামিল শৈব সম্প্রদায়
Posted 03/09/2018
on:
শিব ও লিঙ্গ-০৯/৪ : শৈব সিদ্ধান্ত বা তামিল শৈব সম্প্রদায়
রণদীপম বসু
…
নায়নার সম্প্রদায়ী শৈব সাধকদের রচনাবলী তিরুমুরাই থেকে কালক্রমে দক্ষিণ ভারতে একটি বিশেষ ধরনের শৈব মতবাদ গড়ে উঠেছিল যা শৈব সিদ্ধান্ত নামে পরিচিত। তাঁদের পবিত্র শাস্ত্রের নাম সিদ্ধান্তশাস্ত্র এবং তা চৌদ্দটি খণ্ডে সংকলিত। এই সব ক’টি সংখ্যার রচয়িতাগণ একত্রে সন্তান-আচার্য নামে পরিচিত। এই আচার্যগোষ্ঠীর প্রধান ছিলেন চারজন– ম্যেকণ্ডদেবর, অরুড়্ণন্দি, মরয়জ্ঞানসম্বন্ধর এবং উমাপতি। চৌদ্দটি সিদ্ধান্ত শাস্ত্রের মধ্যে অধিকাংশই তাঁদের রচিত। ১২২৩ থেকে ১৩১৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তাঁদের আবির্ভাবকাল এবং প্রায় শতাব্দীকাল ধরে তাঁরা পরম্পরাক্রমে শৈব সিদ্ধান্ত মত প্রচার করেছিলেন। নায়নারদের স্তোত্রসংগ্রহ যেরূপ প্রধানত ভক্তিরসাত্মক, সিদ্ধান্তশাস্ত্রগুলি তেমনি শৈবতত্ত্ব ও দর্শনমূলক। সিদ্ধান্তশাস্ত্রাবলীর সাথে আবার আগমান্ত ও শুদ্ধশৈব ধর্মদর্শনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্ণনায়–
‘দ্বাদশটি কারিকাবিশিষ্ট শিবজ্ঞানবোধ নামক শৈবদর্শন সংক্রান্ত সংস্কৃত গ্রন্থ রৌরবাগমের একটি অংশ। মেকণ্ডদেবর এই প্রামাণিক গ্রন্থটি তামিল ভাষায় অনুবাদ করিয়াছিলেন। মেকণ্ডদেবরের প্রখ্যাত শিষ্য অরুড়্ণন্দি শিবজ্ঞানসিদ্ধি নামক গ্রন্থ রচনা করেন, এবং তাঁহার শিষ্য মরইজ্ঞানসম্বন্ধর শৈবসময়নেরি নামক গ্রন্থের রচয়িতা। মেকণ্ড এবং মরইজ্ঞান শূদ্রজাতিভুক্ত ছিলেন, কিন্তু মরইজ্ঞানের শিষ্য উমাপতি ব্রাহ্মণকুলোদ্ভব ছিলেন। তাঁহার গুরুভক্তি এত প্রবল ছিল যে তিনি শূদ্র গুরুর উচ্ছিষ্ট প্রসাদ ভক্ষণেও কিছুমাত্র দ্বিধা বোধ করিতেন না। সন্তান-আচার্যদিগের মধ্যে তিনিই সর্বাপেক্ষা অধিক সংখ্যক সিদ্ধান্তশাস্ত্র প্রণয়ন করেন; তৎপ্রণীত এ জাতীয় গ্রন্থসংখ্যা ছিল আট। মাণিক্যবাসগ(হ)র প্রণীত তিরুবাসগম স্তোত্রাবলীতে যেসব দার্শনিক তত্ত্ব সহজ ও সরলভাবে গীতিকবিতার মাধ্যমে প্রকাশিত হইয়াছিল, ঐ সকল ও অন্যান্য গভীরতর শৈব দর্শন এই সব সিদ্ধান্তশাস্ত্রে যুক্তিতর্কের দ্বারা বিশেষ ভাবে ব্যাখ্যাত হইয়াছিল। ইহা হইতে বুঝা যায় যে তামিল ভাষায় শৈব ধর্মদর্শন যামুনাচার্য রামানুজ প্রভৃতি আচার্যগণ কর্তৃক শ্রীবৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের ব্যাখ্যান ও প্রচারের পরে পরিপূর্ণ রূপ গ্রহণ করে, এবং এ কারণ ইহাতে শ্রীবৈষ্ণব দর্শনের কিছু কিছু গৌণ প্রভাব থাকা অসম্ভব নহে। পরবর্তী কালে শম্ভূদেব ও শ্রীকণ্ঠ শিবাচার্য প্রচারিত শুদ্ধশৈব মতবাদে…বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের পূর্ণ প্রভাব পরিস্ফুট হইয়াছিল।’– (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১৯২)
বস্তুত ম্যেকণ্ডদেবরের উপর আরোপিত শিবজ্ঞানবোধম্ (ত্রয়োদশ শতক) এই শৈব সিদ্ধান্ত সম্প্রদায়ের মৌলিক গ্রন্থ। অরুড়্ণন্দির শিবজ্ঞানসিদ্ধিয়ার ও উমাপতির শিবপ্রকাশম এই সম্প্রদায়ের আরো দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। শৈব সিদ্ধান্তবাদীগণ তাঁদের তত্ত্বে কিছুটা বেদান্তের ও ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিলেন, যদিও শৈবধর্মের সবচেয়ে বড় উপাদান যে সাংখ্য তাকে পরিত্যাগ করেননি। তাঁদের প্রধান তত্ত্ব তিনটি– পতি (ঈশ্বর), পশু (জীব) ও পাশ (সংসার বন্ধন)। এই তিনটি তত্ত্বই সৎ বা অস্তিত্ববান। তাঁদের মতে, ঈশ্বর যেমন বাস্তব তাঁর সৃষ্ট জগৎও তেমনই বাস্তব। ঈশ্বর স্বয়ং শিব যিনি স্বেচ্ছায় জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহার করে থাকেন। তিনি সকল প্রকার পরিণাম বা রূপান্তরের উৎস, কিন্তু নিজে পরিণামাধীন নন। ন্যায়-বৈশেষিকদের মতো শৈব সিদ্ধান্তবাদীরাও বিশ্বাস করেন যে, কুম্ভকার যেমন ঘটাদি প্রস্তুত করেন, তেমনি ঈশ্বরও জগৎ সৃষ্টির নিমিত্ত কারণ। মৃত্তিকা যেমন কুম্ভকারের ঘটাদি সৃষ্টির উপাদান কারণ, তেমনি জগৎ সৃষ্টির উপাদান কারণ হচ্ছে মায়া। এখানে বেদান্তের প্রভাব সুস্পষ্ট। এ প্রেক্ষিতে অধ্যাপক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মন্তব্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে,–
‘এখানে বেদান্তের যা সমস্যা শৈব সিদ্ধান্তবাদীদের সেই একই সমস্যা। জগৎরূপ এই কার্যের নিশ্চয়ই কোন উপাদান কারণ আছে, এবং সেই উপাদান কারণ প্রকৃতির দিক থেকে কার্য হতে ভিন্ন নয়। জগৎ জড় বা অচিৎ, ঈশ্বর চেতনা বা চিৎ, সুতরাং ঈশ্বর এই জগতের উপাদান কারণ হতে পারে না। তাহলে জড়রূপী মায়াই উপাদান কারণ। এখানে তিনটি সমস্যা। জড় মায়ার সৃষ্টি হল কিভাবে? তা কি ঈশ্বরের মতই চিরন্তন? তাহলে ঈশ্বর তার স্রষ্টা হতে পারেন না। দ্বিতীয়তঃ ঈশ্বর যদি মায়ার স্রষ্টা হন তাহলে তাঁকে তাঁর চৈতন্যময় সত্তা থেকেই জড়বস্তুর সৃষ্টি করতে হবে। চৈতন্য থেকে জড়ের উদ্ভব কিভাবে হবে? যদি তর্কচ্ছলে ধরে নেওয়া যায়, তা হওয়া সম্ভব, তাহলে ঈশ্বরকে পরিণামী হতে হবে। কিন্তু ঈশ্বর তো অপরিণামী। তৃতীয়তঃ যেহেতু মায়া জড় বা অচিৎ সেহেতু তা স্বয়ং সক্রিয় হতে পারে না। তার জন্য চেতন পরিচালনার প্রয়োজন আছে, কিন্তু ঈশ্বর সেটা কিভাবে করবেন?’– (ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-২০৬)
এই মৌল সমস্যাগুলি সমাধান হবার নয়, এবং শৈব সিদ্ধান্তীরাও এগুলিকে পাশ কাটিয়ে কয়েকটি কল্পিত ধারণা দিয়ে সৃষ্টিরহস্য ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছেন বলে অধ্যাপক নরেন্দ্রনাথে মন্তব্য করেন। শৈব সিদ্ধান্তীরা মায়াকে দু’ভাগ করেছেন– শুদ্ধমায়া ও অশুদ্ধমায়া। আণব ও কর্মের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে মায়া অশুদ্ধমায়ার পর্যবসিত হয়। ঈশ্বর বা শিব সাক্ষাৎভাবে মায়ার উপর ক্রিয়া করেন না, তাঁর চিৎশক্তির মধ্য দিয়ে ক্রিয়া করেন। এইভাবে শিব কর্তৃক চালিত হয়ে মায়া নিজ থেকেই তত্ত্বসমূহ সৃষ্টি করে এবং এই তত্ত্বগুলিই প্রকৃতিতে বিবর্তন ঘটিয়ে জগৎ সৃষ্টি করে সাংখ্য প্রদত্ত ছক অনুসারে। সাংখ্য প্রদত্ত ছকটি হলো–
(১) মায়া (থেকে) => (২) শুদ্ধ মায়া (৩) অশুদ্ধ মায়া
(৩) অশুদ্ধ মায়া (থেকে) => (৪) কাল (৫) নিয়তি (৬) কলা
(৬) কলা (থেকে) => (৭) বিদ্যা (৮) প্রকৃতি
(৮) প্রকৃতি (থেকে) => (৯) চিত্ত (১০) বুদ্ধি
(১০) বুদ্ধি (থেকে) => (১১) অহংকার
(১১) অহংকার (থেকে) => (১২) জ্ঞানেন্দ্রিয় (১৩) কর্মেন্দ্রিয় (১৪) পঞ্চতন্মাত্র
ধর্মের ব্যবহারিক দিকে শৈব সিদ্ধান্তীগণ চরম ভক্তিবাদী। তাঁদের মতে চর্যা, ক্রিয়া, যোগ ও জ্ঞানের দ্বারা আত্মার মুক্তি হয়। অধ্যাপক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ভাষ্যে– ‘চর্যা মার্গের সাধক নিজেকে ঈশ্বরের ভৃত্যের ন্যায় মনে করবেন, যার ফলে তিনি ঈশ্বরের অন্তরঙ্গ হবেন। পরবর্তী পর্যায়ে অর্থাৎ ক্রিয়া মার্গে সাধক ঈশ্বরের সঙ্গে অধিকতর অন্তরঙ্গতা অর্জন করবেন এবং নিজেকে তাঁর সৎ পুত্র হিসাবে মনে করবেন। পরবর্তী পর্যায়ে অর্থাৎ যোগমার্গে এই সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হবে এবং তিনি ঈশ্বরকে তাঁর সখা হিসাবে মনে করবেন। পরবর্তী পর্যায়ে অর্থাৎ জ্ঞানমার্গে তিনি পরিপূর্ণতা লাভ করবেন, তাঁর শিবত্বের উপলব্ধি হবে, যা হচ্ছে মুক্তি বা মোক্ষ। প্রথম স্তর সালোক্য, দ্বিতীয় স্তর সামীপ্য, তৃতীয় স্তর সারূপ্য এবং চতুর্থ স্তর সাযুজ্য।’– (ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-২০৬)
…
(চলমান…)
…
[পূর্বের পোস্ট : নায়নার সম্প্রদায়] [*] [পরের পোস্ট : আগমান্ত শৈব সম্প্রদায়]
…
মন্তব্য করুন