h-o-r-o-p-p-a-হ-র-প্পা

|ভারতীয় দর্শনের বিকাশ-০১ : চার্বাকমতের প্রাক-পটভূমি|

Posted on: 08/07/2015


540652_461563537191202_540159052_n

| ভারতীয় দর্শনের বিকাশ-০১ : চার্বাকমতের প্রাক-পটভূমি |
রণদীপম বসু

ভারতীয় দর্শনের বিকাশ ও বস্তুবাদী পটভূমি

চার্বাক-দর্শন ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন এবং একমাত্র বস্তুবাদী বা জড়বাদী দর্শন। কিন্তু  বস্তুবাদের একমাত্র প্রতিনিধি হয়েও ভারতবর্ষের দর্শনসভায় চার্বাক সিদ্ধান্ত ‘বস্তুবাদী’ আখ্যার পরিবর্তে ‘নাস্তিক’ সংজ্ঞার মাধ্যমেই অধিকতর পরিচিত। এতেই বোঝা যায় যে, মূলধারার সবগুলি দর্শনের রোষানলের মধ্যে থেকেই চার্বাকদেরকে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে হয়েছে।


বলা হয়ে থাকে, চার্বাকদের নীতি প্রধানতঃ নেতিবাচক। ভারতীয় দর্শননীতির বিধানসভায় এঁরা অবতীর্ণ হয়েছেন বিরোধীপক্ষের ভূমিকা নিয়ে। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর ‘Lokayata’ (লোকায়ত) গ্রন্থে বলেন– ‘they have a few doctrines to defend but a lot to assail.’  বস্তুবাদী মতকে সাধারণভাবে আশ্রয় করলেও চার্বাকপন্থীরা বস্তুবাদের খুঁটিনাটিকে তাঁদের উপজীব্য করেননি। তাঁদের মতে, ভারতীয় ঐতিহ্যের যে মূল ধারা ভারতের অধ্যাত্মচিন্তার বিভিন্ন খাতে প্রবহমান, তার অগ্রগতির পথে প্রতিপক্ষরূপে দাঁড়াতেই এঁরা নানাভাবে সচেষ্ট হয়েছেন। চার্বাক দর্শনের যে অংশ আমাদের জ্ঞানের গোচরীভূত তার মধ্যে এই প্রচেষ্টারই সুস্পষ্ট প্রকাশ দেখা যায়। তাই চার্বাক-মত সম্বন্ধে ধারণার প্রস্তুতি হিসেবে ভারতের দর্শনচিন্তার মূলগত ভাবধারা সম্পর্কেও সাধারণ আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। কেননা এই ভাবধারার বিরোধিতার মধ্য দিয়েই চার্বাকীয় চিন্তার অগ্রগতি বলে মনে করা হয়। এবং চার্বাকেতর ভারতের অন্যান্য দার্শনিক-গোষ্ঠি সেই সাধারণ ভাবের দ্বারাই অনুপ্রাণিত।
আর ভারতীয় দর্শনচিন্তার মূলগত ভাব সম্বন্ধে জানতে হলে আমাদের যেতে হবে এর উৎসমুখে– উপনিষদীয় বৈদিক চিন্তাধারার মধ্যে। তবে চার্বাকরা কেন ওই অধ্যাত্ম-ভাবধারার বিপক্ষে এমন বস্তুবাদী লোকায়তিক অবস্থান নিয়েছিলেন তার সামাজিক তাৎপর্যটা অনুধাবন করা না-গেলে এই দর্শনের মূল-স্পন্দনটাই আলোচনার বাইরে থেকে যাবে।

.
১.০ : চার্বাকমতের প্রাক্-পটভূমি

চার্বাক দর্শনের আরেকটি প্রসিদ্ধ নাম হলো লোকায়ত দর্শন। এই নামকরণের পিছনে নিশ্চয়ই কোন সুগভীর সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে। দার্শনিক তাৎপর্যের দিক থেকে এই দর্শনকে বলা হয় ভূতচৈতন্যবাদ, কখনো কখনো দেহাত্মবাদও বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এই নাম দুটির পিছনে যে সে যুগের এক বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে তাও অস্বীকার করার উপায় নেই। বিরোধীপক্ষের দেয়া লোকায়ত নামের তাৎপর্যের মধ্যেই আসলে লুকিয়ে আছে এই দর্শনটির অন্তর্গত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়টি।

একথা স্বীকার করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, সামাজিক বিন্যাসে বস্তুত উচ্চবর্ণের শ্রেণীস্বার্থকে আঘাত করেছিলো বলেই ‘লোকায়ত’ নামটির কিছু কুৎসিত অপব্যাখ্যা অনেকদিন ধরে প্রচলিত, পরবর্তী অধ্যায়ে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে এর কিছু নমুনা আমরা অবগত হবো। বলা হয়ে থাকে, চার্বাক দর্শন হলো–

যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।
ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ ।।  (চার্বাক-ষষ্ঠি)
অর্থাৎ : যতদিন বেঁচে আছ সুখে বাঁচার চেষ্টা কর, ধার করেও ঘি খাবার ব্যবস্থা কর। লাশ পুড়ে যাবার পর আবার কেমন করে ফিরে আসবে?

তার মানে– ‘খাও দাও ফুর্তি করো, জীবের জীবন আর দ্বিতীয়বার ফিরে আসে না’– এজাতীয় স্থূল ভোগবিলাসবাদী জান্তব দর্শনই চার্বাক দর্শন। তাই সংসার-ভোগাসক্ত সাধারণ মানুষের মধ্যে এ দর্শন সহজেই প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এজন্যেই এর নাম হলো ‘লোকায়ত’ দর্শন। এই ভিত্তিতে ‘বিষ্ণুপুরাণ’-এ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যে মায়ামোহের কাহিনীরও সৃষ্টি করা হয়েছে তা আর কিছুই নয়–

অসুররা বৈদিক ধর্মানুসারে কঠোর তপস্যা আরম্ভ করলো। দেবতারা প্রমাদ গুনলেন। তাহলে অসুররাই স্বর্গ ভোগ করবে। আমাদের কী উপায় হবে? তাই দেবতারা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। বিষ্ণু বললেন, ভয় নেই। আমি ব্যবস্থা করছি। বিষ্ণু তাঁর শরীর থেকে মায়ামোহ সৃষ্টি করলেন। বললেন, হে মায়ামোহ! তুমি অসুরদের প্রলুব্ধ করো যাতে তারা বৈদিক ধর্মানুসারী তপস্যার পথ পরিত্যাগ করে ঐহিক ভোগসুখে মত্ত হয়ে পড়ে। মায়ামোহ তপস্যারত অসুরদের কাছে বেদ-বিরোধী পরলোক-বিরোধী ঐহিকভোগবিলাসবাদী বিপরীত দর্শনের মর্ম ব্যাখ্যা করলো। অসুররা মায়ামোহের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে তপস্যার পথ পরিত্যাগ করে ভোগবিলাসের পিছনে ছুটলো। তাদের নৈতিক অধঃপতন ঘটলো। তখন দেবতারা অনায়াসে অসুরদের পরাস্ত করলেন। তাঁদের স্বর্গরাজ্য নিষ্কণ্টক হলো। (বিষ্ণুপুরাণ, অংশ-৩, অধ্যায়-১৭-১৮)


আর অধিকতর প্রচলিত কাহিনীটি হলো– স্বয়ং দেবগুরু বৃহস্পতি অসুরদের নৈতিক অধঃপতন ঘটিয়ে দুর্বল করার জন্য ভোগবাদী দর্শন সৃষ্টি করে শিষ্য চার্বাকের মাধ্যমে প্রচার করেছিলেন। সাংসারিক সুখভোগকামী অজ্ঞ সাধারণ মানুষ এতে নিজের কামনা-বাসনা-লালসা চরিতার্থ করার পিছনে দার্শনিক যুক্তির সমর্থন পাওয়ায় সহজেই এই দর্শন গ্রহণ করে। তাই এর নাম হলো ‘লোকায়ত’ দর্শন।

কিন্তু এসব তো পৌরাণিক কাহিনী-কথা। তার বাইরে চার্বাক-দর্শনের সুদূরপ্রসারী সামজিক তাৎপর্যের চমৎকার দার্শনিক ব্যাখ্যাটি পাওয়া যায় জৈন-দার্শনিক মণিভদ্রসূরি’র রচনায়। প্রসিদ্ধ জৈন-দার্শনিক হরিভদ্রসূরি’র বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ষড়্দর্শনসমুচ্চয়’-এ যেসব আলোচ্য দার্শনিক প্রস্থান ক্রমানুসারে সাজানো হয়েছে সেগুলি হলো– বৌদ্ধ, ন্যায়, সাংখ্য, জৈন, বৈশেষিক, জৈমিনীয় অর্থাৎ মীমাংসা। কিন্তু সবশেষে চার্বাকদর্শনও রয়েছে সংক্ষিপ্তাকারে। তাতে দর্শনের প্রস্থান সংখ্যা দাঁড়ায় আসলে সাতটি। তাই তাঁর গ্রন্থের নাম হিসেবে ‘ষড়্দর্শনসমুচ্চয়’ নামটি কিঞ্চিৎ বিভ্রান্তিকর বটে। হয়তো হরিভদ্রসূরি চার্বাকদর্শনের ওপর খুব একটা গুরুত্ব দিতে চানটি বলে শেষে পরিশিষ্টাকারে সামান্য কিছু বলেছেন। কিন্তু এই গ্রন্থের টীকাকার মণিভদ্রসূরি চার্বাকদর্শনের সামাজিক তাৎপর্য বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করে এই দর্শনের যথেষ্ট গুরুত্ব প্রমাণ করতে চেয়েছেন। এবং বিস্ময়কর ব্যাপার হলো– হরিভদ্রসূরি (৬০০খ্রিস্টাব্দ) তাঁর গ্রন্থের কোথাও বেদান্তদর্শনের নামমাত্র উল্লেখ করেননি। তবে কি তিনি বেদান্তদর্শনকে দর্শন বলেই গ্রাহ্য করেননি! হয়তো তিনি শঙ্করাচার্যের (৮০০খ্রিস্টাব্দ) পরবর্তী হলে অদ্বৈতবাদকে নিশ্চয়ই আমল দিতেন। সে যাক্, মণিভদ্রসূরির ব্যাখ্যার উল্লেখযোগ্য বক্তব্যটুকু হলো–

‘কিং চ প্রত্যক্ষমপি অস্তিতয়া অভ্যুপগম্যতে চেৎ, জগদ্ অনুপহ্নুতমেব স্যাৎ। দরিদ্রে হি স্বর্ণরাশির্মে অস্তি ইতি অনুধ্যায় হেলয়ৈব দৌঃস্থ্যং দলয়েৎ। দাসোহপি স্বচেতসি স্বামিতামবলম্ব্য কিঙ্করতাং নিরাকুর্যাৎ। ন কোহপি স্বানভিমতমালিন্যম্ অশ্নুবীত। এবং ন কশ্চিৎ সেব্যসেবকভাবো দরিদ্রধনিভাবো বা স্যাৎ। তথা চ জগদ্ব্যবস্থাবিলোপপ্রসঙ্গ ইতি সুস্থিতম্ ইন্দ্রিয়গোচর এব প্রমাণম্’। (ষড়দর্শনসমুচ্চয়-এর মণিভদ্র কৃত টীকা ৮১ শ্লোক)
হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায় কৃত তর্জমা :
‘যারা অস্পৃষ্ট, অনাস্বাদিত, অনাঘ্রাত, অশ্রুত, অদৃষ্ট, স্বর্গমোক্ষপ্রভৃতি সুখপিপাসায় চিত্ত সমর্পণ করে, দুঃসাধ্য তপস্যাদি জনিত ক্লেশ স্বীকার করে জীবন ক্ষয় করে তাদের এ ধরনের জীবনযাপন হল মহামূর্খতার দুঃসাহস মাত্র।
আরো একটা কথা– কী আছে কী নেই প্রত্যক্ষকেই তার একমাত্র নিরিখ বলে মেনে নিলে জগৎটাকে আর অস্বীকার করা যায় না (তাহলে জগতের অন্তর্গত আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ সমাজব্যবস্থাকেও বাস্তব বলে স্বীকার করতে হয়)। তখন বঞ্চিত দরিদ্রও মনে করবে– দেশের স্বর্ণভাণ্ডারে আমারও অধিকার আছে। (এ অধিকার কায়েম করে) তখন সেও অনায়াসে নিজের দারিদ্র্যকে পদদলিত করবে। দাসও মনে প্রাণে স্বাধীনতা অবলম্বন করে দাসত্ব করতে অস্বীকার করবে। কেউ আর নিজের অনভিপ্রেত জীবনযাত্রার দৈন্য মেনে নেবে না।
এভাবে সমাজে সেব্য-সেবক সম্বন্ধ বা ধনি-দরিদ্র সম্বন্ধ সম্বলিত শ্রেণীভেদ আর থাকবে না। তখন সংসারের বর্তমান সমাজব্যবস্থা বিলুপ্ত হবে। তাই প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ এই হল চার্বাকের সুস্থির সিদ্ধান্ত।… তাই ধর্মের ভেকধারী পরবঞ্চনাপ্রবণ ধূর্তের দল অনুমান, শাস্ত্রবাক্য প্রভৃতিকে প্রমাণ বলে প্রচার করছে; এসব প্রমাণের দ্বারা পাপপুণ্য, স্বর্গনরক প্রভৃতি অলীক কল্পনাকে সত্য বলে নির্ধারণ করার চেষ্টা করছে; মূঢ় বিভ্রান্ত ইতর জনসাধারণের মধ্যে ধর্মান্ধতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হচ্ছে।’- (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১৪)


এর সারমর্ম হলো– ‘চার্বাক প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ বলে স্বীকার করেন। কিন্তু কেন? কারণ, একমাত্র প্রত্যক্ষকে প্রমাণ বলে মেনে নিলে প্রত্যক্ষের অযোগ্য পরলোক, জন্মান্তর, অবিনশ্বর আত্মা, পূর্বজন্মের কর্মফল ও অদৃষ্টজনিত ইহলোকের দুঃখভোগ, পুণ্যকর্মের দ্বারা বা ঈশ্বরোপাসনার দ্বারা স্বর্গলাভ বা মুক্তি– এ সমস্ত অন্ধ মূঢ় বিশ্বাস আর দুঃখ লাঞ্ছনার জন্য উচ্চবর্ণের কূটবুদ্ধি ও শ্রেণীস্বার্থকলুষিত ধর্মীয় সমাজব্যবস্থাকে দায়ী করবে। তারা মানুষের বাঁচার অধিকারের দাবিতে বিদ্রোহ করবে। এই হলো চার্বাককর্তৃক প্রত্যক্ষকে একমাত্র প্রমাণরূপে স্বীকার করার সামাজিক তাৎপর্য।

চার্বাকদর্শনের এই সুগভীর সামাজিক তাৎপর্য মনে রাখলে ‘লোকায়ত’ কথাটির প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে কষ্ট হবে না। তবে প্রসঙ্গত এটা মনে করার কোনো সঙ্গত কারণ নেই যে, জৈন দার্শনিকরা বুঝি চার্বাকের প্রতি প্রসন্নই ছিলেন। সেব্য-সেবক ধনী-দরিদ্র ভেদশূন্য সমাজব্যবস্থার প্রতি তাদের কোন ভ্রূক্ষেপ বা সহানুভূতি ছিলো এরকম কোন বিশেষ নজির পাওয়া যায় না। বরং ষড়্দর্শনসমুচ্চয়ের পরবর্তী শ্লোক ও তার টীকা থেকে শুরু করে গ্রন্থের পরিসমাপ্তি পর্যন্ত কদর্থিত চার্বাকদর্শনের বিকৃত প্রচলিত ব্যাখ্যারই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে– আত্মা নেই, পরলোক নেই, জন্ম-জন্মান্তর নেই, জীবের জীবন এ জন্মেই শুরু এবং মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হবে, আর ফিরে আসবে না। অতএব পিবত-খাদত-মোদত– অর্থাৎ সবাই মিলে পান করো, খাও দাও ফুর্তি করো– এই হলো চার্বাকদর্শনের শেষ কথা।
উল্লেখ্য, এ-প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখা দরকার যে, জৈনধর্মে বা জৈনদর্শনে যদিও ঈশ্বর বা বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করা হয়নি, কিন্তু পারলৌকিক মুক্তি স্বীকার করা হয়েছে। সাধনার দ্বারা জন্ম-জন্মান্তরের কর্মফল বন্ধন ছিন্ন হলে কর্মক্লেশ-ভারহীন আত্মা শেষ জন্মের পর নিতান্ত হাল্কা হয়ে মহাশূন্যে অন্তহীন উর্ধ্বে পাড়ি জমাবে। কোথায় পৌঁছাবে কেউ জানে না। এর নামই মুক্তি। তবে কি চার্বাকদর্শনের সামাজিক তাৎপর্য অনুধাবন করে জৈন দার্শনিকরাও বিব্রত ছিলেন?

চার্বাকদের দুর্নাম হলো চার্বাক বেদদ্রোহী, অতএব সমাজদ্রোহী, অতএব সনাতন বৈদিক সমাজের ক্ষমার অযোগ্য বিদ্রোহী দার্শনিক। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হলো, চার্বাক বেদের কোন অংশকে প্রধানত আক্রমণ করেছেন?
আক্রমণ করেছেন বেদের কর্মকাণ্ডকে যেখানে বিপুল আড়ম্বরপূর্ণ সুদীর্ঘ প্রক্রিয়া-কণ্টকিত যজ্ঞগুলির বিস্তৃত বর্ণনা করা হয়েছে। এই যজ্ঞগুলির পৌরোহিত্যের ভার দেওয়া হয়েছে ক্ষত্রিয়ের ক্ষমতা দ্বারা সুরক্ষিত এবং ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের ধনরাশির দ্বারা পরিপুষ্ট দক্ষিণার দাক্ষিণ্যে নিরাশঙ্ক নিরাপদ ব্রাহ্মণসম্প্রদায়ের ওপর। অসাধারণ সাহিত্যিক উৎকর্ষে সমুজ্জ্বল, উদার ভাবৈশ্বর্যে সমৃদ্ধ ঋক্-সংহিতা ও অন্যান্য সংহিতার মন্ত্রগুলিকে চার্বাক আক্রমণ করেননি। বৈদিক যাগযজ্ঞের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া হয়েছে মূলত এবং প্রধানত যজুর্বেদ-এর তৈত্তিরীয় সংহিতা-য়।’- (হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১৫)।
যেমন অশ্বমেধ যজ্ঞে বলিদানের জন্য আনীত অশ্বকে করুণাময় বৈদিক ঋষি সান্ত্বনাবাক্য শোনাচ্ছেন–

‘ন বা উ এতন্ম্রিয়সে ন বিষ্যসি দেবা ইদেষি পথিভিঃ সুগেভিঃ।
হরী তে যুঞ্জা পৃষতী অভূতামুপাস্থাদ্বাজী ধুরি রাসভস্য’।। (কৃষ্ণযজুর্বেদ-৪/৬/৯/১০) /(শুক্লযজুর্বেদ-২৫/৪৪) /(ঋগ্বেদ-১/১৬২/২০)
‘ন বা উ এতন্ম্রিয়সে ন রিষ্যসি দেবা ইদেষি পথিভিঃ সুগেভিঃ।
যত্রাসতে সুকৃতো যত্র তে যযুস্তত্র ত্বা দেবঃ সবিতা দধাতু।।’ (বাজসনেয়ী বা শুক্লযজুর্বেদ-সংহিতা-২৩/১৬)
অর্থাৎ :
হে অশ্ব, তুমি এই ভেবে দুঃখ করো না যে বলিপ্রদত্ত তুমি সত্যিই মরে যাচ্ছো বা লোকে তোমাকে হিংসা করছে। তুমি অতি সহজ ও উত্তম পথে সুকৃত ব্যক্তিদের কাম্য দেবতাদের নিকট স্বর্গলোকে চলে যাবে। এমনকি তুমি স্বর্গে ইন্দ্রত্ব প্রাপ্ত হবে। ইন্দ্রের হরিনামক অশ্বদ্বয় এবং মরুৎগণের পৃষতীনামক বলবান ঘোড়া তোমার রথ টেনে নিয়ে যাবে। এই হীন জান্তব জীবনে তুমি ভারবাহী গর্দভের মতো প্রভুর ভার পৃষ্ঠে বহন করে চলেছো। কিন্তু স্বর্গে বলশালী স্বর্গীয় অশ্ব তোমাকে বহন করে চলবে। (সায়ণ ও মহীধর ভাষ্য)।


এই বিচিত্র আর্যদৃষ্টির মাহাত্ম্য অনুধাবন করতে না পেরেই চার্বাকেরা প্রশ্ন তুলেছেন : আহা, অত সহজেই যদি স্বর্গে যাওয়া যায় তবে আর অবোধ পশুটাকে বলি দিচ্ছেন কেন? পশুর বদলে ঋষিবর নিজের বৃদ্ধ পিতাকেই কেন এই সহজ পথে স্বর্গে পাঠাবেন না?–

পশুশ্চেন্নিহতঃ স্বর্গং জ্যোতিষ্টোমে গমিষ্যতি।
স্বপিতা যজমানেন তত্র কস্মান্ন হিংস্যতে।। (চার্বাকষষ্ঠি-৫০)।।
অর্থাৎ : জ্যোতিষ্টোমাদি যজ্ঞে নিহত পশুর যদি স্বর্গলাভ হয়, তবে যজ্ঞকারী যজমান কেন তার পিতাকে হত্যা করে না?


বেদবাদীদের প্রতি এ যে নির্মম বিদ্রূপ। তাই বেদভক্তদের কাছে এটি ‘কুরুচিপূর্ণ উপহাস’ সন্দেহ নেই। কিন্তু এই বিদ্রূপ সত্যদ্রষ্টা ঋষি ও তার মহিমা-কীর্তনীয়ার পক্ষে হজম না করে উপায় কী? সুতরাং তাদের পক্ষেও চার্বাককে বেসামাল গালিগালাজ দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তারপরও কেউ কেউ এর একটা উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন এভাবে– বেদে যাকে বলি দেবার বিধান নির্দিষ্ট রয়েছে তাকে বলি দিলেই সে স্বর্গে যাবে। বৃদ্ধ পিতাকে বলি দেবার কোনো নৈতিক বিধান নেই। তাই বলিপ্রদত্ত পিতা স্বর্গে যেতে পারবেন না। অতএব এটি বেদের মাধ্যমে বিধাতার উদারতারই নিদর্শন। উদারতা তো বটেই। কেননা গীতায় স্বয়ং ভগবানই বলেছেন–

‘বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি।
শুনি চৈব শ্বপাকে চ পন্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-৫/১৮)।
অর্থাৎ : যাঁরা পণ্ডিত অর্থাৎ বেদোজ্জ্বল-বুদ্ধিসম্পন্ন, তাঁরা বিদ্যাবিনয়-সম্পন্ন ব্রাহ্মণ, গরু, হাতি, কুকুর, চণ্ডাল সকলকে সমান দৃষ্টিতে দেখেন।


এই সমদৃষ্টির নমুনা বেদ থেকেই পাওয়া যেতে পারে। ঋগ্বেদের সেই বিখ্যাত পুরুষ-সূক্ত স্মর্তব্য, যে সূক্তে বৈদিক সংহিতার শেষের যুুগে উচ্চ-নীচ বর্ণবিশিষ্ট শ্রেণীবিভক্ত সমাজের সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় ঘটে। এই সূক্তে বিধাতার পা থেকে শূদ্রের উদ্ভবের কথা বলা হয়েছে–

সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ।
স ভূমিং বিশ্বতো বৃহাত্যতিষ্ঠদ্দশাঙ্গুলম্ ।। (ঋগ্বেদ-১০/৯০/১)।
ব্রাহ্মণোহস্য মুখমাসীদ্বাহূ রাজন্যঃ কৃতঃ।
ঊরূ তদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদ্ভ্যাং শূদ্রো অজায়ত।। (ঋগ্বেদ-১০/৯০/১২)।
অর্থাৎ :

পুরুষের সহস্র মস্তক, সহস্র চক্ষু ও সহস্র চরণ। তিনি পৃথিবীকে সর্বত্র ব্যাপ্ত করে দশ অঙ্গুলি পরিমাণ অতিরিক্ত হয়ে অবস্থিত থাকেন। (ঋক্-১০/৯০/১)।।  এর (বিধাতা-পুরুষের) মুখ ব্রাহ্মণ হলো, দু বাহু রাজন্য হলো, যা উরু ছিলো তা বৈশ্য হলো, দু চরণ হতে শূদ্র হলো। (ঋক্-১০/৯০/১২)।।


যদি সহস্রশীর্ষ সহস্রপাদ সহস্রচক্ষু বিরাট বিধাতাপুরুষকে সমাজের সকল মানুষের সমন্বিত রূপের প্রতীকী কল্পনা বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলে হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে সূক্তটির তাৎপর্য দাঁড়াবে–
সমাজের শ্রমজীবী ইতর জনসাধারণ, যারা শারীরিক শ্রমের দ্বারা উচ্চবর্গীয় মুরুব্বি মানুষের ভোগের উপকরণ তৈরি করছে, সমাজের ধনসম্পদ সৃষ্টি করছে, অথচ যে ধনসম্পদে তাদের কোনো অধিকার নেই, সমাজের ভারবাহী সেই মানুষরূপী পশুদলের জন্য স্থান নির্দিষ্ট হয়েছে সমাজের সকলের নীচে। এ বক্তব্যের পূর্ণ তাৎপর্য বুঝতে হলে আমাদের আবার তৈত্তিরীয় সংহিতা-র শরণাপন্ন হতে হবে।’- (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১৬)। ‘তৈত্তিরীয়-সংহিতা’র ঋষির এই তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্যটি হলো–

‘…অন্বসৃজ্যত বৈরাজং সাম শূদ্রো মনুষ্যাণামশ্বঃ পশুনাং তস্মাত্তৌ ভূতসংক্রামিণাবশ্বশ্চ শূদ্রশ্চ তস্মাচ্ছূদ্রো যজ্ঞেহনবক্লপ্তো ন হি দেবতা অন্বসৃজ্যত তস্মাৎ পাদাবুপ জীবতঃ পত্তো হ্যসৃজ্যেতাং প্রাণা বৈ ত্রিবৃদর্দ্ধমাসাঃ পঞ্চদশঃ প্রজাপতিঃ সপ্তদশস্ত্রয় ইমে লোকা অসাবাদিত্য একবিংশ এতস্মিন্বা এতে শ্রিতা এতস্মিন্ প্রতিষ্ঠিতা য এবং বেদৈতাস্মিন্নেব শ্রয়ত এতস্মিন্ প্রতি তিষ্ঠতি।। (কৃষ্ণযজুর্বেদ-সংহিতা-৭/১/১)।
অর্থাৎ :
…শূদ্র ও অশ্ব বিধাতার পা থেকে জন্মেছে। সুতরাং অশ্ব যেমন ব্রাহ্মণাদি উচ্চ ত্রিবর্ণের ভার বহন করে, তাদের আদেশ পালন করে, শূদ্রও তেমনি ব্রাহ্মণাদি বর্ণত্রয়ের আজ্ঞাবহ দাসরূপে বিচরণ করবে। অর্থাৎ এরা সম্পূর্ণভাবে উচ্চবর্ণের অধীন। উচ্চবর্ণের সেবা করাই এদের একমাত্র ধর্ম। এজন্যই শূদ্রের বৈদিক ক্রিয়াকলাপে কোনো অধিকার নেই। (হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়-কৃত মন্ত্র ও সায়ণ-ভাষ্যের তর্জমা)


হিন্দু দার্শনিক ও ধর্মশাস্ত্রকাররা যে বেদকে ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে দেখেননি তথা বেদের কোন্ অংশ পূর্ব যুগে রচিত আর কোন‌্ অংশ পরবর্তী যুগে রচিত এ সমস্যা নিয়ে তাঁরা মাথা ঘামাননি তা বুঝা যায় তাঁদের মতে সমগ্র বৈদিক সাহিত্যই ঈশ্বরের বাণী অথবা অনাদি অপৌরুষেয় বাণী হিসেবে সকল বিধানই তর্কাতীতভাবে মেনে নেয়ার অভ্যস্ততা থেকে। তাই বেদবাণী অনুসরণ করেই ধর্মশাস্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানভাজন মনুসংহিতায় শূদ্রদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী নৃশংস বিধানসমূহ রচিত হয়েছে। চার্বাকদর্শনের সামাজিক তাৎপর্য অনুধাবনে বেদসম্মত সমাজসংগঠনে ব্রাহ্মণ্যবাদী গ্রন্থ মনুসংহিতার অন্তর্গত দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করলেই কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী লোকায়তিক চার্বাক-মত উত্থান অনিবার্য হয়ে উঠেছিলো তা বুঝতে সহায়ক হবে।

(চলবে…)
[ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]

[আগের অধ্যায় : বৈদিক যুগ ও আর্য-সংস্কৃতি] [*] [পরের পর্ব : মনুর ব্রাহ্মণ্যবাদ মনুসংহিতা]

[ চার্বাকের খোঁজে অধ্যায়সূচি ]

2 Responses to "|ভারতীয় দর্শনের বিকাশ-০১ : চার্বাকমতের প্রাক-পটভূমি|"

মনুসংহিতার ব্রাক্ষন্যবাদের জন্য হিন্দু সমাজ রসাতলে গিয়েছে। ব্রাক্ষনরা মনুসংহিতার আলোকে চলতে রাজি কিন্তু গীতার আলোকে চলতে চায়না অথচতারা গীতা ভাগবত পাঠ শুনায় এমনকি কৃষ্ণ মন্ত্রে দীক্ষা দেয়।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

রণদীপম বসু


‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভাল।...’
.
.
.
(C) Ranadipam Basu

Blog Stats

  • 1,231,639 hits

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 188 other subscribers
Follow h-o-r-o-p-p-a-হ-র-প্পা on WordPress.com

কৃতকর্ম

সিঁড়িঘর

দিনপঞ্জি

জুলাই 2015
রবি সোম বুধ বৃহ. শু. শনি
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031  

Bangladesh Genocide

1971 Bangladesh Genocide Archive

War Crimes Strategy Forum

লাইভ ট্রাফিক

ক’জন দেখছেন ?

হরপ্পা কাউন্টার

Add to Technorati Favorites

গুগল-সূচক

Protected by Copyscape Web Plagiarism Check

Flickr Photos