h-o-r-o-p-p-a-হ-র-প্পা

| কালের স্মৃতিচিহ্ন | ঢাকা: আর্মেনিয়ান চার্চ |

Posted on: 04/03/2011


Armanian Church
| কালের স্মৃতিচিহ্ন | ঢাকা: আর্মেনিয়ান চার্চ |
-রণদীপম বসু

পুরান ঢাকার আর্মেনীটোলায় যে আর্মেনীয় গীর্জাটি রয়েছে তা-ই ‘আর্মেনিয়ান চার্চ’ (Armanian Church)  হিসেবে পরিচিত। এটি নির্মিত হয় ১৭৯১ সালে। ঐতিহ্যবাহী এই গীর্জার সাথে জড়িয়ে আছে ঢাকায় আর্মেনীয়দের ইতিহাস। আর্মেনীটোলা বা আর্মানিটোলা নামটিও এসেছে আর্মেনীদের কারণে। ধারণা করা হয় এই গীর্জা নির্মাণের আগে তাদের ছোট একটি উপাসনাগার ছিলো। এখন যে জায়গায় গীর্জাটি দাঁড়িয়ে আছে, ১৭৮১ সালে সেখানে ছিলো আর্মেনীদের গোরস্থান। গীর্জা নির্মাণের জন্য গোরস্থানের আশেপাশে যে বিস্তৃত জমি তা দান করেছিলেন আগা মিনাস ক্যাটচিক নামের এক আর্মেনীয়। আর লোকশ্রুতি অনুযায়ী গীর্জাটি নির্মাণে সাহায্য করেছিলেন চারজন আর্মেনীয়। এরা হলেন মাইকেল সার্কিস, অকোটাভাটা সেতুর সিভর্গ, আগা এমনিয়াস এবং মার্কার পোগজ। গীর্জাটি লম্বায় সাড়ে সাতশো ফুট, দরজা চারটি, জানালা সাতটি। এর পাশেই ছিলো একটি ঘড়িঘর। এটি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন জোহানস কারু পিয়েত সার্কিস। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ঘড়িঘরটি ভেঙে গিয়েছিলো বলে জানা যায়। গীর্জায় বৃহৎ আকারের একটি ঘণ্টা ছিলো। এই ঘণ্টা বাজার শব্দ নগরের প্রায় সব স্থান থেকে শুনা যেত বলে সাক্ষ্য পাওয়া যায়। এই ঘণ্টার শব্দ শুনেই নাকি অধিকাংশ ঢাকাবাসী নিজ নিজ সময়ঘড়ি ঠিক করে নিতেন। ১৮৮০ সালের দিকে আর্মেনী গীর্জার এই বিখ্যাত ঘণ্টাটি স্তব্ধ হয়ে যায়, যা আর কখনো বাজেনি।

Armanian Church


বর্তমানে ঢাকায় আঠারোটি আর্মেনী বংশদ্ভূত পরিবার রয়েছে বলে শোনা যায়। তবে কোন কালেই ঢাকায় আর্মেনীদের সংখ্যা খুব একটা বেশি ছিলো না। আর্মেনীরা কবে ঢাকায় এসেছিলেন তা জানা না গেলেও ধারণা করা হয় মুঘল আমলে ভাগ্য বদলাতে দেশ-বিদেশ থেকে যখন অনেকেই এসেছিলেন ঢাকায়, সম্ভাব্য সপ্তদশ শতকে আর্মেনীরাও তখন দু’-একজন করে ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেন এ অঞ্চলে। সেই থেকে এই অঞ্চল আর্মেনীটোলা নামে পরিচিত। অষ্টাদশ ও উনিশ শতকের প্রথমার্ধে অতিক্ষুদ্র একটি সম্প্রদায় হওয়া সত্ত্বেও ঢাকা শহরে আর্মেনীরা ছিলো যথেষ্ট প্রভাবশালী। এর কারণ, তাদের ছিলো বিত্ত। অষ্টাদশ শতকে লবণ ব্যবসা ছিলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া। লবণ উৎপাদন ও বিতরণের জন্য কোম্পানি নিয়োগ করতো ঠিকাদার। পূর্ববঙ্গে লবণের ঠিকাদারদের অধিকাংশই ছিলেন আর্মেনী। ঠিকাদারি ছাড়াও পান, পাট ও কাপড়ের ব্যবসায় ছিলো তাদের কর্তৃত্ব। জমিদারীও ছিলো অনেকের।
.
Armanian Church
উনিশ শতকের ঢাকায় পরিচিত ও প্রভাবশালী পরিবার হিসেবে যে ক’টি আর্মেনী পরিবারের নাম পাওয়া যায় সেগুলো হলো- পোগস, আরাতুন, পানিয়াটি, স্টিফান, লুকাস, কোজা মাইকেল, মানুক, হার্নি, সিরকোর এবং সার্কিস। এদের বিত্তের ভিত্তি ছিলো জমিদারি ও ব্যবসা। বিদেশি হয়েও জমিদারি কেনার কারণ হতে পারে- আভিজাত্য অর্জন এবং সমাজের শীর্ষে থাকা। এসব ধনী আর্মেনীয়নরা ঢাকায় নিজেদের থাকার জন্য তৈরি করেছিলেন প্রাসাদতুল্য সব বাড়ি। যেমন ফরাসগঞ্জের বর্তমান রূপলাল হাউস ছিলো আরাতুনের। মানুক থাকতেন সদরঘাটে। বর্তমানে ‘বাফা’ যে বাড়িতে, সেটি ছিলো নিকি পোগজের। পরে আর্মেনীটোলায় নির্মিত হয়েছিলো ‘নিকি সাহেবের কুঠি’। আনন্দরায় স্ট্রিটে ছিলো স্টিফানের বাড়ি। তাজমহল সিনেমা যেখানে রয়েছে সেখানে ছিলো পানিয়াটির অট্টালিকা। উনিশ শতকের মাঝামাঝি অনেক আর্মেনী ঝুঁকে পড়েন ব্যবসার দিকে। চা, মদ, ইউরোপীয় জিনিসপত্র, ব্যাংক ইত্যাদি। ১৮৫৬ সালে সিরকোরই ঢাকায় প্রথম ঘোড়ার গাড়ি চালু করেন, যা পরিচিত ছিলো ‘ঠিকা গাড়ি’ নামে। কিছুদিনের মধ্যেই এই ব্যবসা বেশ জমে উঠে এবং কালক্রমে তাই হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ঢাকার প্রধান যানবাহন।
.
Armanian Church
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আর্মেনীদের অনেকের জমিদারি হাতছাড়া হতে থাকে। এমনিতে আর্মেনীরা খুব রক্ষণশীল, কিন্তু ঐ সময় চলছিলো একটি পরিবর্তনের প্রক্রিয়া। এরা তখন পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং অনেকে জমিদারি বিক্রি করে ব্যবসার জন্য কলকাতায় চলে যান। ফলে উনিশ শতকের শেষার্ধে ষাট-সত্তরের দশক থেকে সম্প্রদায়গতভাবে আর্মেনীদের প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস পেতে থাকে। তখন ঢাকা শহরের বিভিন্ন কাজকর্মে, সভাসমিতিতে আর্মেনীরা নিজেদের যুক্ত করে নেন। নিকি পোগজ প্রতিষ্ঠা করেন পোগজ স্কুল। আরাতুন ছিলেন ঢাকা নর্মাল স্কুলের অধ্যক্ষ। ঢাকার প্রথম মিউনিসিপ্যাল কমিটিতে ছিলেন সার্কিস। ১৮৭৪-৭৫ সালে ঢাকা পৌরসভার ন’জন কমিশনারের মধ্যে দু’জন ছিলেন আর্মেনী- জে.জি. এন পোগজ এবং এন.পি. পোগজ।
.
Armanian Church
আর্মেনীটোলায় থিতু হয়ে বসার পর আর্মেনীরা এখানে তাঁদের এই গীর্জা নির্মাণ করেন। মৃত্যুর পর ঢাকার আর্মেনীদের কবর দেয়া হয় আর্মেনী গীর্জার চতুর্দিকের প্রাঙ্গণে। প্রাঙ্গণের পরিসর ছোট হওয়ার কারণেই হয়তো গীর্জাটির গোটা প্রাঙ্গণ এমনকি বারান্দার মেঝেতেও প্রচুর সমাধিফলক চোখে পড়ে। অধিকাংশ এপিটাফ বা স্মৃতিফলকে উদ্ধৃত রয়েছে ধর্মগ্রন্থের বাণী।  এছাড়া জনৈক ক্যাটচিক আভেটিক থমাসের সমাধির ওপর তাঁর স্ত্রী কলকাতা থেকে কিনে এনে বসিয়েছিলেন সুন্দর এক মূর্তি, যা এখনো টিকে আছে। এপিটাফে তিনি তার স্বামীকে উল্লেখ করেছিলেন ‘বেস্ট অব হাজব্যান্ডস’ বলে। আর্মেনিয়ান চার্চের মতো শান্ত, নিরিবিলি জায়গা ঢাকা শহরে খুব কমই আছে। সোয়া দু’শ বছরের পুরনো ও ঐতিহ্যময় গীর্জাটির রক্ষণাবেক্ষণ এখনো অবশিষ্ট আর্মেনী পরিবাররাই করে থাকে। সোয়া দু’শ বছরেরও অধিক বয়সী এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যটি সংরক্ষণে এখন যথাযথ কর্তৃপক্ষের আন্তরিক দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন বলে মনে হয়।
.
Armanian Church
(তথ্যসূত্র: ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী / মুনতাসীর মামুন।)
[ আর্মেনী গীর্জার আরো ছবি এখানে ]

1 Response to "| কালের স্মৃতিচিহ্ন | ঢাকা: আর্মেনিয়ান চার্চ |"

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

রণদীপম বসু


‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভাল।...’
.
.
.
(C) Ranadipam Basu

Blog Stats

  • 1,231,697 hits

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 188 other subscribers
Follow h-o-r-o-p-p-a-হ-র-প্পা on WordPress.com

কৃতকর্ম

সিঁড়িঘর

দিনপঞ্জি

মার্চ 2011
রবি সোম বুধ বৃহ. শু. শনি
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031  

Bangladesh Genocide

1971 Bangladesh Genocide Archive

War Crimes Strategy Forum

লাইভ ট্রাফিক

ক’জন দেখছেন ?

হরপ্পা কাউন্টার

Add to Technorati Favorites

গুগল-সূচক

Protected by Copyscape Web Plagiarism Check

Flickr Photos